নিবন্ধন ব্যবস্থা কি রাজনৈতিক হাতিয়ার?
বিবিসি বাংলা
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশে সম্প্রতি দুটি স্বল্পপরিচিত রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেওয়ার পর প্রত্যাশী অন্য দলগুলো নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেছে, নির্বাচনের আগে নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, যথাযথ যাচাই শেষেই নিবন্ধন দেওয়া-না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এবার নিবন্ধন পেতে ৯৩টি দল আবেদন করেছিল। এর মধ্যে ১২টি দলকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করেছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে তথ্যে গরমিল থাকার কথা জানিয়ে বাকি ১০টি দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) নামে যে দুটি দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে; তাদের পরিচিতি নেই বললেই চলে। এর প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে নাগরিক ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টিসহ নিবন্ধন প্রত্যাশী কয়েকটি দল।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এই নির্বাচন কমিশন তো সরকারের ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। তাদের বিন্দুমাত্র নিরপেক্ষতা নেই। সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য গঠিত প্রতিষ্ঠানটি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়েছে। নিবন্ধন দেওয়া না দেওয়ার বিষয়টিকে তারা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে।’
তিনি বলেন, ‘এতগুলো সুপরিচিত, সক্রিয় এবং রাজপথে সংগ্রামরত রাজনৈতিক দল বাদ দিয়ে যাদের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে তাদের নাম আপনারা কয়জন শুনেছেন? তাদের কি আপনারা চেনেন? তাদের কি আদৌ কোনো অফিস, নেতাকর্মী আছে?’
এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আমাদের জানামতে নির্বাচন কমিশনের প্রতিবেদনেও আমাদের দল নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিল। ৩৬টি জেলা-মহানগর আর ১০৪টি উপজেলায় আমাদের দলের অফিস কমিটি থাকার তালিকা জমা দিয়েছি। কিন্তু সরকারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী আমাদের নিবন্ধন দেওয়া হয়নি।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনের ওপর কোনোরকম হস্তক্ষেপ করি না। নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন, তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবেই কাজ করার সক্ষমতা আছে, এখানে হস্তক্ষেপের বা সরকারের ভূমিকার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’
সামরিক সরকার সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন শুরু হয়। এর আগে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতীক অলিখিতভাবেই নির্ধারিত ছিল। মনোনয়ন দেওয়ার পর সেই প্রতীকেই প্রার্থীরা নির্বাচন করতেন। নতুন রাজনৈতিক দল বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ হতো চাহিদা অনুযায়ী, কখনো কখনো লটারির মাধ্যমে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নির্দিষ্ট প্রতীক নিয়ে রাজনৈতিক দল হিসাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে নিবন্ধন করার প্রথা চালু করা হয়। সেই সময় এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন বলেছিল, নিবন্ধিত না হলে কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন করতে পারবে না। সেই সময়কার নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন জানান, মূল উদ্দেশ্য ছিল, একটা যোগ্যতা নিয়ে যেন রাজনৈতিক দলগুলোই নির্বাচনে অংশ নেয়। না হলে অর্থের অপচয় হয়, রাষ্ট্র যন্ত্র ব্যবহার হয়, এজেন্টরা বসতে পারে না, ব্যালটে অসংখ্য প্রতীক দিতে হয়, কিন্তু তারা হয়তো এক পার্সেন্ট ভোটও পায় না। ফলে নির্বাচনের উপযুক্ত দলগুলোকে নিশ্চিত করতে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। শুরুর দিকে নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালুর বিরোধিতাও করেছিল বাম মোর্চা এবং ইসলামী ঐক্যজোটের মতো কিছু রাজনৈতিক দল। এর বিরুদ্ধে রিটও হয়েছিল। যদিও তাতে শেষ পর্যন্ত ঠেকানো যায়নি। সেই বছর ১১৭টি আবেদন পড়লেও শর্তসাপেক্ষে ৩৯টি দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। এর প্রায় ১৫ বছর পর সেই নিবন্ধন প্রক্রিয়াকেই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা, এমন প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
অভিযোগ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘তারা যে অভিযেগ করেছে তার আদৌ কোনো ভিত্তি নেই। আমরা সব যাচাই-বাছাই করে, যে প্রক্রিয়ায় করতে হয়, সেই নিয়ম মোতাবেক আমরা সবকিছু করেছি। মাঠ পর্যায়ে যেসব অফিস বা লোকবল থাকতে হবে, সেগুলো যাচাই করে, অনুসন্ধান করে দেখেছি। তাতে দুটা দলের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের আমরা নিবন্ধন দিয়েছি। বাকিগুলোর শর্টফল (ঘাটতি) ছিল, তাই তাদের দেয়া হয়নি। তিনি জানান, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইন ২০২০ অনুযায়ী, তাদের আর নির্বাচন কমিশনে আপিল করার সুযোগ নেই। আগামী নির্বাচনের আগে তাদের নতুন করে আবেদন করারও সুযোগ নেই।’
তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশনের ওপর সরকারের প্রভাব আছে কিনা, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও তারা যে দুটি দলের নিবন্ধন দিয়েছে, তাদের নিয়ে বেশ প্রশ্ন উঠছে। এখন ইলেকশন কমিশনের উচিত পরিষ্কার করে দেওয়া, তালিকা দিয়ে দেওয়া যে কীভাবে কোথায় কোন তথ্যের ভিত্তিতে তাদের নিবন্ধন দেওয়া হলো। তিনি বলেন, দুটা দল, যাদের নাম আমি কখনো শুনিনি, আরও অনেকে শোনেনি, তারা নিবন্ধন পেল। অথচ কিছু দল আছে যারা বছরের পর বছর ধরে আন্দোলন করছে, মিটিং মিছিল করছে, তারা নিবন্ধন পেল না। ফলে সবার সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক।