Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বিশেষ অভিযানেও বন্ধ হচ্ছে না

ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া গডফাদাররা অধরা

টাকা যাচ্ছে বিদেশে অবস্থানরত চক্রের হাতে * বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে -ডিবি প্রধান

Icon

সিরাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া গডফাদাররা অধরা

প্রতীকী ছবি

গত ১৫ দিনে ডিএমপির ৫০ থানা এলাকায় আট শতাধিক ছিনতাইকারী গ্রেফতার হয়েছে। পুলিশের বিশেষ অভিযানের পরও ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বন্ধ হচ্ছে না। প্রতিদিনই রাজধানীর কোনো না কোনো স্থানে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ছোটখাটো ঘটনায় অনেকে আইনের আশ্রয় নেন না। তবে বড় ধরনের ঘটনায় তোলপাড় হয়।

ঈদের পরদিন ৩০ জুন রামপুরায় হামলা করে ছিনতাইকারীরা ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের প্রযোজনা সহকারী রাকিবুল হাসানের ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। এর পরদিন ফার্মগেটে ছিনতাইকারীদের হাতে পুলিশ কনস্টেবল মনিরুজ্জামান খুন হন। এ দুই ঘটনার পর পুলিশ প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। কিন্তু পুলিশের কড়া তৎপরতার মধ্যেও সক্রিয় ছিনতাইকারী চক্র। প্রতিনিয়ত তারা পথচারীদের কাছ থেকে সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে। মাঝেমধ্যে তারা প্রাণও কেড়ে নিচ্ছে। সর্বশেষ রোববার রাতে ছিনতাইকারীদের হাতে ধানমন্ডি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী আদনান সাঈদ রাকিবের প্রাণ গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক অভিযানে মাদকাসক্ত ও ভাসমান ছিনতাইকারীরা ধরা পড়ছে। কিন্তু নেপথ্যের গডফাদারদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। গ্রেফতারদের জামিনের ব্যবস্থা করছে গডফাদাররা। ছিনতাইকারীরা জামিনে বেরিয়ে এসে আবার একই অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। দেশের বাইরে অবস্থান করে গডফাদারদের কেউ কেউ ছিনতাই চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে। ছিনতাইয়ের টাকার একটি বড় অংশ তাদের কাছে যাচ্ছে।

রোববার রাতে ধানমন্ডি শেখ জামাল ক্লাব মাঠের সামনে ১৭ বছর বয়সি আদনান ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। বাধা দেওয়ায় ছিনতাইকারীরা তাকে ছুরিকাঘাত করে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১২টার দিকে তার মৃত্যু হয়। ১১ জুলাই রাতে রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকায় ভোরের কাগজের সম্পাদনা সহকারী মাহমুদুল হাসান ছিনতাইয়ের শিকার হন। তার ব্যাগ ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। একই দিন নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন দুই ভাই আরমান হোসেন রোহান ও মোহাম্মদ রিপন। ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরমান নিহত ও রিপন গুরুতর আহত হন। ৪ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে ছিনতাইয়ের শিকার গৃহবধূ পাপিয়া আক্তার যুগান্তরকে জানান, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা মোড়ে তুরাগ বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ামাত্র এক ছিনতাইকারী চাকুর ভয় দেখিয়ে আমাকে সবকিছু দিয়ে দিতে বলে। এতে আমি ভয় পেয়ে যাই-এরপর ছিনতাইকারী আমার ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমি চিৎকার দিলে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে তাকে ধরে ফেলে। এ ঘটনায় থানায় মামলা করেছি। পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) জিয়াউল আহসান তালুকদার যুগান্তরকে জানান, ছিনতাইকারীদের ধরতে বিশেষ অভিযান চলছে। ২ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত শতাধিক ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে-সজিব হাওলাদার, আল আমিন, হোসেন মিয়া, আকাশ, রাকিব, হৃদয় শেখ, বিল্লাল হোসেন, ইউসুফ, বিল্লাল, উজ্জ্বল হোসেন। তিনি বলেন, গ্রেফতারদের অতীত অপরাধ বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, তাদের অনেকের নামে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। কেউ কেউ একাধিকবার গ্রেফতারও হয়। জামিন পাওয়ার পর তারা আবার একই পেশায় জড়িয়ে পড়েছে।

কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহীনুর রহমান জানান, বিশেষ অভিযানে আমরা অর্ধশতাধিক ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছি। তাদের মধ্যে রয়েছে-মাহবুবুল হোসেন, মাইকেল ওরফে শাহ আলম, নয়ন, সুমন, মিরাজ হাওলাদার ওরফে মিলন, কফিল ইসলাম, সজীব হোসেন, জুয়েল, মহসিন সিকদার, আলী হোসেন, টিটু, ফরহাদ হোসেন, শরিফ ওরফে সজল, মো. ইউসুফ, মানিক, সবুজ, রাকিব হাওলাদার, নাহিদ চৌধুরী, মানিক, মাসুম, সাব্বির ওরফে শুভ, আরমান মৃধা, রাব্বি।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্র জানায়, সুদূর আমেরিকা থেকে গুলশানের একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ১৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করা হয়। আমেরিকায় আত্মগোপন করা পলাতক সন্ত্রাসী সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল ও মেহেদী হাসানের পরিকল্পনায় ওই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গ্রেফতার চারজন ডিবিকে জানায়, চঞ্চল ও মেহেদীর নির্দেশে তারা রাজধানীতে ছিনতাই করে। ছিনতাই করা টাকার একটি বড় অংশ তাদের (চঞ্চল-মেহেদী) কাছে পাঠানো হয়। ডিবি জানায়, ২৩ মে সারা দিনের বিক্রির ১৫ লাখ টাকা ব্যাগে ভরে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী জিল্লুর রহমান বাসার উদ্দেশে রওনা দেন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে উত্তর বাড্ডার ছয়তলা মসজিদের কাছে যেতেই দুই ছিনতাইকারী ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে টাকার ব্যাগ কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।

বিশেষ অভিযানের মধ্যেও ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বন্ধ না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। গডফাদারদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। ধানমন্ডির ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, ছিনতাইয়ের টাকার বড় একটা অংশ অমেরিকায় অবস্থানরত চঞ্চলের কাছে যাচ্ছে। বিদেশে থেকেই সে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ডিবির কার্যক্রম চলমান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গডফাদাররা ভদ্রবেশী অপরাধী। তারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও জড়িত। নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও তারা অংশ নেয়।

কিছু দিন আগে ডিবির হাতে গ্রেফতার ছিনতাইকারী জয় জবানবন্দিতে জানায়, ‘অনেক আগেই আমি ছিনতাই ছাড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু গুরু (গডফাদার) ইয়াসিনের কারণে তা পারিনি। ইয়াসিন আমাকে জামিনে সহায়তা করেন। আমোদ-ফুর্তির ব্যবস্থা করেন। ছিনতাই করা পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে দেন। তার কাছে আমি নানাভাবে ঋণী। ঋণ পরিশোধ করতে পারছিলাম না। ছিনতাই ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছার কথা জানালে ইয়াসিন আমাকে এলাকা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এলাকা ছাড়তে রাজি হলে তিনি আমাকে হত্যার হুমকি দেন। যে কোনো সময় ইয়াসিন আমার বড় ধরনের ক্ষতি করে ফেলতে পারে-এমন আশঙ্কায় ছিনতাই ছাড়তে পারিনি।’ মুগদার ছিনতাইকারী চক্রের গডফাদার ইয়াসিন। মুগদায় ইয়াসিনের ছিনতাইকারীদের জন্য একটি বিনোদন কেন্দ্র আছে। সেখানে ছিনতাইকারীরা চিত্তবিনোদন করে।

ডিবি সূত্র জানায়, গডফাদাররা (আশ্রয়দাতা) মাঠ পর্যায়ের ছিনতাইকারীদের দিয়ে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করান। তারা ছিনতাইয়ের ভাগ পান। ছিনতাই ছাড়াও চুরি ও মাদক বিক্রিসহ নানা অপরাধ করান ‘মাঠকর্মীদের’ দিয়ে। রাজধানীতে অন্তত ২০ জন গডফাদার আছে। যারা ছিনতাইকারীদের পেশায় থাকতে বাধ্য করে। ছিনিয়ে নেওয়া পণ্যের বিক্রির ব্যবস্থা করে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম