ঈদ চাহিদা মেটাতে ব্যাংকগুলোর দৌড়ঝাঁপ
দুদিনে ৩৪ হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা
নয় মাসে তারল্য কমেছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা, হাত পাততে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঈদ উপলক্ষ্যে গ্রাহকদের নগদ টাকার চাহিদা বেড়েছে। ফলে তারা ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে নিচ্ছেন। অনেকে আগের সঞ্চয় ভেঙেও টাকা তুলছেন। গ্রাহকদের বাড়তি চাহিদা মেটাতে ব্যাংকগুলো হিমশিম খাচ্ছে। ব্যাংক নিজস্ব তহবিল থেকে গ্রাহকদের বাড়তি টাকার জোগান দিতে না পেরে অন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা নিয়েছে।
রোববার ও সোমবার-এ দুই দিনে বিভিন্ন ব্যাংক অন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তারল্য সুবিধা নিয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কলমানি থেকে ধার নিয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা, স্বল্পমেয়াদি ধার নিয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ তারল্য সুবিধা নিয়েছে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এক সপ্তাহে ব্যাংকগুলো শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ তারল্য সুবিধা নিয়েছে ২৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় সার্বিকভাবে তারল্যের পরিমাণ কমে যাওয়ায় এই সহায়তা নিতে হয়েছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোয় জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে তারল্য কমেছে প্রায় ৬৩ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের জুলাইয়ের শুরুতে ব্যাংকগুলোয় তারল্য ছিল ৪ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। গত মার্চে তা কমে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকায়। এপ্রিলে তারল্য কিছুটা বেড়েছে। তবে সার্বিকভাবে সংকট এখনো কাটেনি। ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা উত্তোলন করা হয় কুরবানির ঈদের সময়। এ কারণে এক মাস আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করেছিল যে, ঈদের সময় কোনো ব্যাংকে যাতে নগদ টাকার সংকট না হয়। প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও সহায়তা নিতে বলা হয়েছিল। এর আলোকে ব্যাংকগুলোও নগদ টাকার জোগান আগে থেকেই নিশ্চিত করে রাখে। এক সপ্তাহে ব্যাংকগুলো শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ তারল্য সুবিধা নিয়েছে ২৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৫ জুন ২ হাজার ৭০০ কোটি, ২২ জুন ৩ হাজার ৫০০ কোটি, ২১ জুন ৭ হাজার ৪০০ কোটি, ২০ জুন ৬ হাজার ৫০০ কোটি, ১৯ জুন ৪ হাজার ৬০০ কোটি এবং ১৮ জুন ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নিয়েছে।
ঈদের আগে গত রোববার ও সোমবার ছিল ঈদের আগে শেষ ব্যাংকিং লেনদেন। ওই দুই দিন গ্রাহকরা সবচেয়ে বেশি টাকা তুলেছেন। এ কারণে ওই সময়ে ব্যাংকগুলোও নগদ টাকার জন্য দৌড়ঝাঁপ করেছে। রোববার কলমানি মার্কেট (এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের এক দিনের জন্য ধার) নিয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা এবং একই দিনে অন্য ব্যাংক থেকে স্বল্পমেয়াদি বা ৬ থেকে ১৪ দিনের জন্য ধার নিয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। সোমবার কলমানি থেকে ধার নিয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা এবং স্বল্পমেয়াদি ধার নিয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে সীমিত পরিমাণে ২৪ থেকে ৯২ দিন মেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি ধার নিয়েছে কিছু ব্যাংক। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া বিশেষ তারল্য সুবিধার আওতায় নেওয়া হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।
এসব ব্যাংক ৩৪ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। এবার ঈদের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানির দায় মেটানোর জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি কমিয়ে দিয়েছে। যে কারণে ব্যাংক থেকে ডলার কেনা বাবদ অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যায়নি। উলটো রিজার্ভ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু ডলার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কিনেছে। এতে একদিকে কিছু টাকা ব্যাংকগুলোয় এসেছে, অন্যদিকে ডলার নিয়ে রিজার্ভ কিছুটা বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে রিজার্ভ বেড়ে প্রায় ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এবার ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ ছিল। ভোক্তাদের সার্বিকভাবে কেনাকাটার পরিমাণও কম। যে কারণে আগের চেয়ে নগদ টাকার চাহিদাও ছিল কম।
অন্যান্য বছর ঈদের সময় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লেও এবার তেমন একটা বাড়েনি। গত রোজার মাস এপ্রিলে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬৮ কোটি ডলার। এবার কুরবানির ঈদ উপলক্ষ্যে ২৬ জুন পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ২০০ কোটি ডলারের বেশি। রেমিট্যান্স কম আসায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে বেশি ডলার কিনতে পারেনি। ফলে বাজারে টাকার প্রবাহও বাড়েনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোয় আমানত প্রবাহ নিম্নমুখী ছিল। এপ্রিলে এসে কিছুটা বেড়েছে। জুনে ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন খাতে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হয় বলে আমানত প্রবাহ কিছুটা বাড়বে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে ডলার সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে। এ খাতে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা চলে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। এছাড়া গড়ে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমে যাওয়া এবং আমানত প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার কারণে তারল্য প্রবাহ কমেছে।