যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার
জাতীয় সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন নয়: মুফতি ফয়জুল করীম
সরকারের পদত্যাগের দাবিতে মাঠে থাকব
আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল
প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
জাতীয় সরকারের অধীনে ছাড়া আর কোনো নির্বাচনে যাবে না চরমোনাই পিরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। যুগান্তরকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন দলের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম। জাতীয় সরকার গঠন ও বর্তমান সরকারের পদত্যাগ দাবিতে তার দল আন্দোলনের মাঠে থাকবে বলেও জানান তিনি। সে লক্ষ্যে শুক্রবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে দলটি। ওই সমাবেশ থেকে পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানান ফয়জুল করীম।
সাম্প্রতিক সময়ে সিটি করপোরেশনসহ প্রায় সব নির্বাচনে অংশ নিয়ে আলোচনায় আসে ইসলামী আন্দোলন। ঢাকার ২ সিটিতে ২ জনসহ দেশের বিভিন্ন পৌরসভায় ৫ কাউন্সিলর এবং ১৩ ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেন তাদের প্রার্থীরা। অন্যান্য নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীর পরই দাঁড়ায় তাদের ভোটের অবস্থান। গাজীপুরে ভোটের হিসাবে তৃতীয় হলেও ৪৫ হাজারের বেশি ভোট পায় হাতপাখা। সর্বশেষ খুলনা ও বরিশাল সিটিতে নৌকার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয় ইসলামী আন্দোলন। বিএনপি নির্বাচন বর্জনের পর এভাবে নিজেদের ভোটের মাঠে ২য় শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে দলটি। নৌকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আবহ তৈরির মাধ্যমে গ্রহণযোগ্যও করতে থাকে বর্তমান সরকারের সব নির্বাচন। বক্তৃতা-বিবৃতিতে সরকারের বিরুদ্ধে কিছু না বলা আর বিএনপি ঘোষিত যুগপৎ আন্দোলনে না গিয়ে আওয়ামীঘেঁষা বলেও পরিচিতি পায় দলটি। কিছুদিন আগে বরিশালে এক জনসভায় ইসলামী আন্দোলনকে আওয়ামী লীগের বি-টিম বলে ঘোষণা দেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর। ঢাকায় হেফাজতের ওপর হামলা, মামুনুল হক ও রফিকুল ইসলাম মাদানী গ্রেফতারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। পরে অবশ্য ইসলামী আন্দোলনের পক্ষে এর তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়।
১২ জুনের সিটি নির্বাচনে বরিশালে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন দলের নায়েবে আমির সৈয়দ ফয়জুল করীম। কর্মী-সমর্থকদের কাছে যার পরিচয় শায়েখে চরমোনাই নামে। প্রায় ৩৪ হাজার ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হলেও ভোটের দিন ঘটে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা। নগরের কাউনিয়া ও চৌমাথা এলাকায় দুই দফা হামলা হয় ফয়জুলের ওপর। দ্বিতীয় দফা হামলায় রক্তাক্ত হন তিনি। এরপরই মূলত পালটে যায় দৃশ্যপট। বর্তমান সরকারের পতনের লক্ষ্যে আন্দোলনের ঘোষণা দেন ফয়জুল। আওয়ামী লীগকে জালেম আখ্যা দিয়ে পতন না হওয়া পর্যন্ত শরীরের শেষ রক্তবিন্দু ঢেলে মাঠে থাকার ঘোষণা দেন তিনি। সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে বরিশাল ও খুলনার ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন দলের আমির চরমোনাই পির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। একই সঙ্গে সিলেট ও রাজশাহী সিটি নির্বাচনে থাকা মেয়রপ্রার্থীদের প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন তিনি। সরকারের পতন দাবিতে ইসলামী আন্দোলন মাঠে নামবে উল্লেখ করে রেজাউল করীম বলেন, ‘নায়েবে আমিরের ওপর হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ হবে। সেই বিক্ষোভ থেকে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করব আমরা।’
চলমান বাস্তবতায় নির্বাচন ও আন্দোলন নিয়ে কী ভাবছে ইসলামী আন্দোলন, তা জানতে চাইলে দলের নায়েবে আমির মুফতি ফয়জুল করীম বলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যে সম্ভব নয়, এর প্রমাণ পেয়ে গেছি। বরিশালে কী হলো? শতকরা ৫২ ভাগ ভোট কারা দিল? বেলা ১২টার পর তো কোনো কেন্দ্রে ভোটার ছিল না। সকালেও ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। অথচ ফলাফলে ৮৮ হাজার ভোট পেয়েছে নৌকা। এটা কোন পাগল বিশ্বাস করবে? বরিশালে আওয়ামী লীগ নিরপক্ষে কোনো নির্বাচনে কোনোদিন ৮৮ হাজার ভোট পেয়েছে? নির্বাচনে সব কেন্দ্রে নৌকার পক্ষে কাজ করেছে প্রশাসন। ইভিএমেও ছিল স্মার্ট জালিয়াতি। ভোটাররা চাপ দিয়েছে হাতপাখায় আর ভোট পড়েছে নৌকায়। অধিকাংশ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের লোকজন দাঁড়িয়ে থেকে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করেছে। ভোটারের ভোট নৌকার এজেন্ট দিয়ে দিয়েছে-এমন প্রমাণও আছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো-আমার ওপর পিশাচের মতো হামলা চালানো হয়েছে। যারা হামলা চালিয়েছে, তারা আমার সন্তানের বয়সি। আমি একজন বয়স্ক মানুষ। চুল-দাড়ি পাকা। মাথায় টুপি। তারপরও কীভাবে আমাকে জখম করল? এই সরকারের হাতে তো কেউ নিরাপদ নয়। এদের হাতে গণতন্ত্র নিরাপদ নয়, নির্বাচন নিরাপদ নয়।’ বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যেখানে নির্বাচন বর্জন করেছে, সেখানে কেন নির্বাচনে গেলেন-জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে না গেলে দেশবাসী জানত না যে কেবল বিএনপি নয়, সবার সঙ্গে একই আচরণ করে এই জালেম সরকার। আমরা ভোটে গিয়েছি বলেই আজ সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনাদের অবস্থান কী জানতে চাইলে ফয়জুল বলেন, ‘বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার একজন গৃহপালিত মেরুদণ্ডহীন প্রাণী। আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই সিইসি প্রার্থীদের মৃত্যু কামনা করে। আমি আহত হয়েছি আর উনি জিজ্ঞেস করছেন মারা গেছি কি না। আবার বলছেন বিষয়টি আপেক্ষিক, অর্থাৎ উনি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে যেমন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়, তেমনই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকলে কোনোদিনই নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। তাই আমরা বর্তমান সরকার এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবি করছি। জাতীয় সরকারের অধীন ছাড়া আমরা আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেব না। সেই জাতীয় সরকার গঠন ও বর্তমান সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব।’ জাতীয় সরকারের প্রধান যদি হন শেখ হাসিনা, তাহলে কি নির্বাচনে যাবেন-জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি তো স্পষ্ট করেই বলেছি যে বর্তমান সরকারের পতন চাই। সেখানে শেখ হাসিনা যদি জাতীয় সরকারের প্রধান হন, তাহলে পতন হলো কোথায়?’
অনেকের ধারণা ইসলামী আন্দোলন আওয়ামী লীগের বি টিম, এই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের রাজনৈতিক কৌশল ও আদর্শে চলি। বিএনপি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে বৈঠকে যায়নি। আমরাও যাইনি, তাই বলে যেমন আমরা বিএনপি হয়ে যাইনি, তেমনই নির্বাচনে গিয়েছি বলে আমরা আওয়ামী লীগও হয়ে যাইনি। আজ আমরা সরকার পতনের ডাক দিয়েছি। এখন কি আমাদের বিএনপির বি-টিম বলবেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে বিএনপি। আমরা বলছি জাতীয় সরকারের কথা। তারাও এই সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় না, আমরাও চাই না। আসলে কে কার বি টিম, সেটা আলোচনা নয়, আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক কি না, সেটা হচ্ছে বিষয়। আমরা আমাদের নীতি-আদর্শে চলি। তাই কখনো মনে হয় বিএনপি আবার কখনো আওয়ামী লীগ। প্রকৃতপক্ষে আমরা বাংলার জমিনে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েমের অন্দোলন করছি।’