Logo
Logo
×

শেষ পাতা

রাজশাহী বঙ্গবন্ধু চত্বর প্রকল্প

অর্ধেক কাজেই শেষ বরাদ্দের সব টাকা

ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ, বরাদ্দের বড় অংশই লোপাট * আর এক টাকাও দেবে না সরকার * আরডিএ-পরামর্শক পরস্পর দোষারোপ

Icon

আনু মোস্তফা, রাজশাহী

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অর্ধেক কাজেই শেষ বরাদ্দের সব টাকা

দুই বছরের প্রকল্পে সাত বছরে কাজ হয়েছে অর্ধেকের কম। বরাদ্দকৃত ৬০ কোটি টাকাও শেষ। এখন অর্ধেক কাজ বাকি রেখেই রাজশাহী বঙ্গবন্ধু চত্বর প্রকল্পটি সমাপ্তি ঘোষণার প্রস্তুতি চলছে। রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ২০১৪ সালে নগরীর তালাইমারীতে বঙ্গবন্ধু চত্বর নামের মেগা প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল। ২০১৯ সালে টেন্ডার হয়। তিন দফা সময় বাড়িয়ে প্রকল্প শেষের সময় ছিল ২০২২ সালের ৩০ জুন।

বারবার নকশা বদলের কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হয়েছে ১২৫ কোটি টাকা। প্রকল্প শেষ করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে দাখিলকৃত সংশোধিত ডিপিপিতে অতিরিক্ত ৬০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর এক টাকাও দেবে না তারা। এখন আরডিএ কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটির অর্ধেক কাজ বাকি রেখে সমাপ্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ছয় মাস ধরে বন্ধ আছে কাজ।

এদিকে প্রকল্পটির এ দুরবস্থার জন্য প্রকল্প পরিচালকসহ আরডিএর কর্মকর্তারা সরাসরি দায়ী করেছেন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘সাতত্য আর্কিটেক’কে। তাদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই বারবার প্রকল্পের নকশা বদলে ব্যয় বাড়িয়েছেন পরামর্শক।

এ কারণে প্রকল্পটি মাঝপথে আটকে গেছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মূল নকশায় দফায় দফায় বদল এনে ব্যয় বাড়িয়ে নিজেরা লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেছে। নিজেদের পরামর্শক ফি দুই কোটি থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন কোটি টাকা করেছে। তাদের ‘অনৈতিক হস্তক্ষেপে’ প্রকল্পের প্রথম পিডিকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এসব কারণে প্রকল্পটি লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে।

তবে সাতত্য আর্কিটেকের প্রিন্সিপাল আর্কিটেক্ট রফিক আজম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বঙ্গবন্ধু চত্বরটিকে তারা একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা করতে চেয়েছিলেন। এজন্য কয়েকবার মূল ডিজাইন বদল করেন। এতে ব্যয় বাড়ে; কিন্তু সেটা ভালো কাজের জন্য করেছিলেন। প্রকল্পটির চলমান অনিশ্চিত অবস্থার জন্য তিনি আরডিএকেই দায়ী করেন।

২০১৪ সালে সাবেক চেয়ারম্যান বজলুর রহমান প্রকল্পটি হাতে নেন। জমি অধিগ্রহণ খাতে ২৯ কোটি ২৮ লাখ এবং অবকাঠামো ও বিভিন্ন উপকরণ খাতে ৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকাসহ মোট ব্যয় ধরা হয় ৬০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের জুনে।

প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণকাজের ঠিকাদারি পায় ঢাকার দি ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড আর্কিটেক্ট। মূল ঠিকাদার কাজটি নিজেরা না করে রাজশাহীর আসাদুল্লাহ অ্যান্ড ব্রাদার্সকে হস্তান্তর করেন। তারা ভবনের দেওয়াল ও ছাদ তৈরি শেষ করেন। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের এটুকু কাজই হয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শেখ কামরুজ্জামানের দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে টেন্ডার হলেও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাজ শুরু হয়। সর্বশেষ সংশোধিত ডিপিপিতে প্রকল্প সম্পন্নের সময় বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০২৪ সালের ৩০ জুন। সংশোধিত ডিপিপিতে অতিরিক্ত ৬০ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় ডিপিপি অনুমোদন না করায় বিপাকে পড়েছে আরডিএ।

পিডি শেখ কামরুজ্জামান বলেন, যেহেতু সংশোধিত ডিপিপি পাশ হয়নি; তাই মন্ত্রণালয় আমাদের বলেছে, নিজেদের টাকা থাকলে তা দিয়ে প্রকল্প শেষ করতে। তারা আর এক টাকাও দিতে পারবে না। এখন আমরা ভাবছি, যতটুকু কাজ হয়েছে, তা দিয়েই প্রকল্পটির কাজ শেষ করতে। পিডির দাবি, প্রকল্প অবকাঠামোর ৯৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।

নগরীর তালাইমারি মোড়ে দৃষ্টিনন্দন ‘বঙ্গবন্ধু চত্বর’টি এক দশমিক ৪২ একর জমির ওপর হচ্ছে। প্রকল্পের মূল প্রস্তাবনায় ভবনের বেজমেন্টে গাড়ি পার্কিং, আর্ট গ্যালারি, জলধারাবেষ্টিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ছাড়াও প্রশ্বস্ত গ্রাউন্ড ফ্লোর, আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম, লাইটিং এবং ডিজিটাল স্ক্রিনযুক্ত স্থায়ী আর্ট গ্যালারি এবং মিউজিয়াম হওয়ার কথা। ফার্স্ট ফ্লোরের মধ্যে আধুনিক রেস্তোরাঁ, দৃষ্টিনন্দন ল্যান্ডস্কেপ, উন্মুক্ত স্থানে বসা এবং বিনোদনের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা রাখা।

পরামর্শক ইতোমধ্যে ২ কোটি ২৩ লাখ টাকা নিয়েছেন। পরার্শক ফি আরও দেড় কোটি টাকা বাড়িয়েছেন। প্রকল্প বুঝে না নিয়ে আরডিও ইতোমধ্যে ঠিকাদারকে পুরো বিল শোধ করেছে। সাবেক চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনের ‘অনৈতিক চাপে’ পিডি প্রকল্পের পুরো বিল ছাড় করেন বলে অভিযোগ আছে। যদিও সাবেক চেয়ারম্যান এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে কাজ না করে বিল ছাড় নিয়ে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সাবেক চেয়ারম্যানের ফাইল নোটের কিছু নথিপত্র এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

যাতে দেখা যায়, প্রকল্প তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত একজন প্রকৌশলী অসম্পন্ন কাজের বিল ছাড় না করতে ফাইলে নোট দিয়েছিলেন। এটি আমলে না নিয়ে সাবেক চেয়ারম্যান সাড়ে তিন কোটি টাকার একটি বিল ঠিকাদারকে দেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে। পরে ওই তদারকি প্রকৌশলী প্রশান্ত কুমার পালকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। সাবেক চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন অবশ্য এই অভিযোগও অস্বীকার করেন।

সংশোধিত ডিপিপিতে প্রতিটি খাতেই অতিরিক্ত ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। কোনো কোনো খাতে দ্বিগুণ ব্যয় প্রস্তাব রয়েছে। মূল ডিপিপিতে রাজশাহী-ঢাকায় যাতায়াতের খরচ ছিল পাঁচ লাখ টাকা। প্রস্তাবিত ডিপিপিতে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০ লাখ টাকা। জ্বালানি খাতে ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে আড়াই লাখ, স্টেশনারিতে দুই লাখ থেকে বাড়িয়ে ছয় লাখ, লাইব্রেরির বই ক্রয় খাতে পাঁচ লাখ থেকে বাড়িয়ে ২০ লাখ এবং প্রচার ও বিজ্ঞাপনে পাঁচ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১০ লাখ টাকার প্রস্তাব রয়েছে। কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ খাতে ১০ লাখ টাকার স্থলে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৫ লাখ, সম্মানি ভাতা দুই লাখ থেকে বেড়ে সাত লাখ; পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ড্রাফটিং, প্রিন্টিং, ইউটিলিটি সংযোগ ফি প্রভৃতি খাতে পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকার প্রস্তাব রয়েছে। এভাবে বিভিন্ন খরচ কয়েক গুণ বেড়ে প্রকল্প ব্যয় হয়েছে ১২৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

আরডিএর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রথম পিডিকে না জানিয়েই নকশায় বদল আনেন। আপত্তি জানান প্রথম পিডি আরডিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল্লাহেল তারিক। পরে তাকে পিডির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। জানা যায়, সরকারের অর্থ সংকটের কথা মাথায় রেখে তারিক প্রকল্পটি মূল নকশা অনুযায়ী মূল বরাদ্দের মধ্যে শেষ করতে চেয়েছিলেন। তিনি টেন্ডার শিডিউল অনুযায়ী সব কাজ বুঝে নিতে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। এমনকি অসম্পন্ন কাজের জন্য অগ্রিম বিল ছাড়েও কঠোর আপত্তি করে একাধিকবার চেয়ারম্যানকে নোট দেন। কিন্তু পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও সাবেক চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন তাতে ক্ষুব্ধ হন। একপর্যায়ে তারিককে প্রকল্পের পিডি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে, বঙ্গবন্ধু চত্বর প্রকল্পে বরাদ্দের একটা বড় অংশই লোপাট হয়েছে। প্রকল্প দুর্নীতির সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা যেমন জড়িত, তেমনই সাবেক চেয়ারম্যান ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানও সম্পৃক্ত। এসব অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন পরামর্শক রফিক আজম।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম