বরিশালে মহানগরের শীর্ষ নেতাদের না রাখায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া
আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল
প্রকাশ: ১০ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে ছাড়াই নির্বাচনি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছেন। এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
তবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মন্ত্রী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। এদিকে আচরণবিধি ভেঙে মোটরসাইকেল-গাড়ির শোভাযাত্রা ও নির্বাচনি সমাবেশ করায় ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী ফয়জুল করীমকে তলব করেছে নির্বাচন কমিশন। রিটার্নিং কর্মকর্তা হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে।
নির্বাচনি কমিটিতে আওয়ামী লীগের মহানগর সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর এবং সাধারণ সম্পাদক মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকে না রাখায় নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এতে দলের বিরাজমান বিভক্তি কতটা সামাল দেওয়া যাবে, সেই প্রশ্ন নেতাকর্মীদের। অবশ্য খোকন সেরনিয়াবাত বলছেন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেয়রের দায়িত্বে থাকায় দুজনকে কমিটিতে রাখা হয়নি। নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের শঙ্কা থেকে এমন করা হয়েছে। তবে তার সঙ্গে মেয়র সাদিকের অনুসারীরা একমত নন। তাদের মতে, কমিটিতে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিরা আছেন। সেখানে এ দুজনকে না রাখার যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।
সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে প্রধান নির্বাচনি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সিটি নির্বাচন পরিচালনার উপদেষ্টা কমিটি ঘোষণা করেন খোকন। ৩০ এপ্রিল ঘোষিত ১৬ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি নিয়ে চলমান বিতর্ক-সমালোচনার মধ্যে তিনি ৩১ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করেন। এতে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে প্রধান করা হয়েছে। হাসানাত খোকনের বড় ভাই এবং মেয়র সাদিকের বাবা।
কমিটিতে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, বরিশাল সদর আসনের এমপি ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস, মাহবুব উদ্দিন আহম্মেদ বীরবিক্রম, বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল এবং সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরনের স্ত্রী সাবেক এমপি জেবুন্নেসা আফরোজ রয়েছেন। এ কমিটিতে বরিশালের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিত্ব এবং ১৪ দলের নেতারাও আছেন। কমিটিতে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের পদ-পদবিধারী কোনো নেতা নেই। এ নিয়ে সোমবার রাত থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
সাদিক অনুসারী একাধিক ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন পরিচালনা কমিটি এবং উপদেষ্টা কমিটিতে মহানগর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের স্থান হয়নি। আসলে নৌকার প্রার্থী কি চাইছেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। দলে বিভক্তি টিকিয়ে রেখে কীভাবে নির্বাচন করবেন, সেটা খোকনই ভালো বলতে পারবেন। ওয়ার্ড সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের বাদ দিয়ে হাজার কমিটি করা হলেও মাঠে একটাই মেসেজ যায়-তিনি সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চাইছেন না। তবে কি ধরে নেব-খোকন সেরনিয়াবাত নির্বাচিত হলে আমাদের নগর ছেড়ে চলে যেতে হবে?’
এ ব্যাপারে খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, কৌশলগত কারণেই কমিটিতে জেলা চেয়ারম্যান ও মেয়রকে রাখা হয়নি। এছাড়া এটা আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে করা। এখানে আমি কাকে রাখব আর রাখব না, সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি জেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর বলেন, আমি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলেছি। নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে জেলা চেয়ারম্যান কিংবা মেয়রের থাকার ক্ষেত্রে আইনি কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বলে জানিয়েছেন তারা। এরপরও কেন আমাদের বাদ দিয়ে কমিটি হলো, সেটা প্রার্থী ভালো বলতে পারবেন। এটা ঠিক হয়নি। কর্মীদের কাছে ভুল মেসেজ যাচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, নৌকার পক্ষে আছি, থাকব। দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে কাজ করব ইনশাল্লাহ।’
এদিকে সোমবার বরিশালে হাতপাখার প্রার্থী ফয়জুল করীমকে দেওয়া সংবর্ধনা ও তার বরিশালে আসা উপলক্ষ্যে হওয়া শোডাউনকে আচরণবিধির লঙ্ঘন উল্লেখ করে নোটিশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নোটিশে আজ হাজির হয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে এ ব্যাপারে মৌখিক এবং লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে তাকে। বরিশাল সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির সোমবার ওই নোটিশ দেন। এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য ফয়জুল করীমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন ধরেননি তিনি। দলের কেন্দ্রীয় মিডিয়া সেলের সহকারী সমন্বয়কারী শহিদুল কবির বলেন, ‘মনোনয়ন দাখিল, বাছাই, চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ ও প্রতীক বরাদ্দের আগে পুরোদমে প্রচার-প্রচারনা শুরু হয় না। সেক্ষেত্রে এখনই আচরণবিধির এতটা প্রয়োগ বিস্ময়কর। তাও যদি নিরপেক্ষ হতো। এর আগে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নগরে শোভাযাত্রা-সমাবেশ-মোটরসাইকেল-গাড়ির বহর নিয়ে শোডাউন করেছেন। তখন রিটার্নিং অফিসার কই ছিলেন? তখন যদি তিনি নোটিশ দিতেন আমরা সাবধান হয়ে যেতাম। তিনি নৌকাকে কিছু বললেন না আর দোষ হলো হাতপাখার? আমি মনে করি, এই নোটিশ দেওয়ার মাধ্যমে তিনি নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন।’ ইসলামী আন্দোলনের এই নেতার মতো রিটার্নিং অফিসারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে। লাঙ্গলের প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপসের পক্ষে ঢাকায় নির্বাচন কমিশনে ওই অভিযোগ করেছেন তার প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী বরিশাল জেলা জাপার আহ্বায়ক মহসিন উল ইসলাম হাবুল। ডাকযোগে পাঠানো লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, ‘নানাভাবে জাপা প্রার্থীর সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। তার কাছ থেকে নিরপেক্ষ আচরণ পাচ্ছি না আমরা। এছাড়া তিনি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক কেন্দ্রীয় নেতার ঘনিষ্ঠ। এই অবস্থায় হুমায়ুন কবির দায়িত্বে থাকলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না। তাই নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে তাকে প্রত্যাহার করা প্রয়োজন।’ অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে রিটার্নিং কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এটা আসলে তুলনা করার কোনো বিষয় না। নৌকার প্রার্থী আমাদের কথা মেনে অনেক কর্মসূচি বাতিল করছেন। তাকে আচরণবিধি মানার বিষয়ে আমরা যা বলছি, তাই শুনছেন তিনি। হাতপাখার প্রার্থীকেও শোডাউন করতে নিষেধ করা হয়েছিল, তিনি শোনেননি।’ জাতীয় পার্টির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন আমাকে এখানে দায়িত্ব দিয়েছে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্নের। আইন মেনে সেই দায়িত্ব পালন করছি আমি। এখানে নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হলে কমিশন দেখবে। আমি কোনোরকম পক্ষপাতিত্ব করছি না।’
জাতীয় পার্টির মেয়রপ্রার্থীর জনসংযোগ : বরিশাল নগরীর ৫নং ওয়ার্ডের ১নং পলাশপুরে জাতীয় পার্টির মনোনীত লাঙ্গল প্রতীকের মেয়রপ্রাথী প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন তাপস জনসংযোগ করেন। তিনি পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ও বরিশাল মহানগরের সদস্য সচিব। জনসংযোগকালে আরও উপস্থিত ছিলেন মহানগর কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল জামান চৌধুরী, কামাল তালুকদার, মো. মোরশেদ ফোরকান; জাতীয় পার্টির উপজেলা সাধারণ সম্পাদক মো. জয়নাল আবেদীন, মহানগর কমিটির সভাপতি মো. গিয়াস উদ্দিন, সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম, শ্রমিক নেতা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, কৃষক পার্টির নেতা মোসলেম ফরাজি, সদস্য বাবু ননী গোপাল, মো. ডালিম ও মো. জুম্মান। ওই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ও বরিশাল মহানগরের আহ্বায়ক অধ্যাপক মহসিন উল ইসলাম হাবুল।