Logo
Logo
×

শেষ পাতা

৫ বছরে অর্ধশত খুন

চট্টগ্রামে অপ্রতিরোধ্য কিশোর গ্যাং

নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুব নেতারা * বিটাকে জোড়া খুনে হোতাসহ গ্রেফতার ৮

Icon

এমএ কাউসার, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চট্টগ্রামে অপ্রতিরোধ্য কিশোর গ্যাং

চট্টগ্রামে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, অস্ত্রবাজি, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে প্রায় সব অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে কিশোররা। তাদের ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে ‘গডফাদাররা’।

কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিয়ে অনেকেই রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে। দিন যত যাচ্ছে ততই ভয়ংকর উঠছে কিশোর গ্যাং। দিন-দুপুরে তারা ছিনতাই করছে। কথায় কথায় মারামারি ও অস্ত্রবাজি করছে। খুন করতে দ্বিধাবোধ করছে না। সর্বশেষ সোমবার রাতে নারীঘটিত বিষয় নিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে দুই তরুণ খুন হন। এ ঘটনার পর চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং এর অপতৎপরতার বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে অন্তত অর্ধশত খুনের ঘটনা ঘটেছে। তাদের দৌরাত্ম্য কমাতে গত চার বছর আগে তালিকা করা হলেও সেটি আর হালনাগাদ করা হয়নি। ফলে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে পাড়া-মহল্লার উঠতি বয়সি কিশোররা।

সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ৫ এপ্রিল নগরীর চান্দগাঁও থানার ফরিদের পাড়া এলাকায় চাঁদা চেয়ে না পেয়ে আমজাদ হোসেনের পায়ে ড্রিল করে কিশোর গ্রুপের সদস্যরা। যুবলীগ নামধারী এক বড়ভাইয়ের নেতৃত্বে এলাকায় নানা অপরাধে জড়িত ছিল ওই কিশোর গ্রুপ। একই বছরের ১৪ এপ্রিল কোতোয়ালি থানার কাজির দেউড়ির ব্যাটারি গলি এলাকায় ইয়াবা সেবনের টাকা না পেয়ে বাবা রঞ্জন বড়ুয়াকে ছুরিকাঘাতে খুন করে ছেলে রবিন বড়ুয়া। বাবাকে হত্যাকারী রবিনও কিশোর বয়সি। এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২০১৯ সালে নগরীর ৩০০ স্পটে সক্রিয় থাকা ৫৫০ কিশোর গ্যাং সদস্যের তালিকা করে সিএমপি। তাদের দমাতে শুরু করে অভিযান। অভিযানের মুখে বছরের শেষ দিকে দাপট কিছুটা কমলেও বন্ধ হয়নি কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা।

গত ৪ বছরে সেই তালিকা হালনাগাদ হয়নি। অথচ সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নগরীর পাড়া-মহল্লায় প্রতিনিয়ত আধিপত্য বিস্তার এবং হিরোগিরি দেখাতে মরিয়া হয়ে উঠছে কিশোররা। প্রতি বছর গ্যাংয়ে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সদস্য। গত কয়েক বছরে চট্টগ্রামে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে কিশোর অপরাধীরা। একের পর এক খুন, মাদক চোরাচালান, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও আধিপত্য বিস্তারে জড়িয়ে পড়ছে তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় ছাত্র-যুব নেতা, সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর এবং বস্তি এলাকায় সন্ত্রাসীরা কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করছেন। অভিভাবকদের অসচেতনতা এর জন্য অনেকটাই দায়ী।

পুলিশ জানায়, সোমবার পাহাড়তলী থানাধীন সাগরিকা বিটাক এলাকার জোড়া খুনের ঘটনায় মূল হোতা হিসাবে মো. ইলিয়াছ নামে এক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাকেসহ ৮ জনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে ইলিয়াছ দুটি কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করত। মেয়েঘটিত বিষয় নিয়ে দুগ্রুপের মধ্যে ঝগড়া হলে তাদের ইলিয়াছের অফিসে ডাকা হয়। সেখানে উভয় গ্রুপের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হলে এক গ্রুপের সদস্যদের উদ্দেশ করে ইলিয়াস ‘শালাদের ধরে মার’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ফয়সাল, বাবু, বিপ্লব, কার্তিকসহ আরও ১০-১৫ জন মিলে মাসুম এবং সজিবকে এলোপাতাড়ি ছুরি মেরে মারাÍক আহত করে। পরে তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পর জড়িতদের গ্রেফতারে ডিবি (পশ্চিম ও বন্দর) কাজ শুরু করে। কক্সবাজার যাওয়ার পথে চকরিয়া হতে মো. ইলিয়াছকে গ্রেফতার করা হয়।

জানা যায়, পাহাড়তলী থানাধীন সাগরিকা বিটাক মোড়ে ইলিয়াছের একটি অফিস রয়েছে। সে অফিসে বসে দুটি কিশোর গ্রুপকে পরিচালানা করে ইলিয়াছ। ইলিয়াছের নেতৃত্বে যেসব কিশোর রয়েছে তাদের মধ্যে বিটাক এলাকার-মো. আজাদ, মো. রমজান, পারভেজ তালুকদার ওরফে বরিশাইল্ল্যা পারভেজ, মো. হানিফ, মো. হারুন, মো, সম্রাট আকবর, মো. মারুফ, মো. রিয়াজ, মো. জনি, রবিউল ও নজরুল অন্যতম। এসব কিশোরের মাধ্যমে বিটাক এলাকার শিল্প-কারখানাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া একে খান এলাকায় পিচ্চি মারুফ, কর্নেলহাট শাহী পাড়া এলাকায় আবু তৈয়ব, উত্তর পাহাড়তলী জোলাপাড়া এলাকায় সোহেল আধিপত্য বিস্তার করে থাকে। ৯নং উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহিরুল আলম জসিমের বিরুদ্ধেও কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ওই এলাকার যুবলীগ নেতা বেলাল উদ্দিন জুয়েল, তারেক জামাল, ওসমান, আরিফ, ইউনুস, আকবর শাহ এলাকায় ইসমাইল, গোলপাহাড় এলাকায় আনোয়ারুল আজিম একজন জনপ্রতিনিধির নেতৃত্বে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে আসছে।

নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় কিশোর গ্যাং ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। জামাল খান ও চকবাজার ওয়ার্ডেও কিশোরগ্যাংয়ের অপতৎপরতা রয়েছে। নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের ৩০০ স্পটে বিশেষ করে উঠতি বয়সি কিশোররা বড়ভাইদের মাধ্যমে গ্যাংয়ে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। তারা মাদক ব্যবসা, ইয়াবা সেবন, মোটরসাইকেল ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়াচ্ছে। সামান্য বিষয় নিয়ে খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে তারা।

জানতে চাইলে সিএমপির এডিসি (পিআর) স্পিনা রানী প্রামাণিক যুগান্তরকে বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এর জন্য পরিবার থেকে শুরু করে সামাজিক পরিবেশসহ বিভিন্ন কিছু দায়ী। উঠতি বয়সি কিশোরদের মধ্যে সব সময় উদ্দীপনা কাজ করে। ফলে খারাপ দিকে প্রভাবিত হয় বেশি। এজন্য পরিবারকে ভূমিকা নিতে হবে। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা অবনতি হলে কঠোরভাবে প্রতিহত করবে। তবে কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা সিএমপি করেছে এমন তথ্য আমার কাছে নেই।’

সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (উত্তর) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সোনাহর আলী শরীফ বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা রোধে ডিবি সব সময় সক্রিয় থাকে। যখনই কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় তখনই ডিবি এ ধরনের অপরাধীদের চিহ্নিত করা, তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা কারা তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। এরা যে দল বা মতেরই হোক না কেন তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করে। কিশোর গ্যাংয়ের হালনাগাদ তালিকা করার কোনো চিন্তা সিএমপির আছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সিএমপির চারটি ক্রাইম ডিভিশন আছে। তারা অন্যান্য অপরাধীর পাশাপাশি কিশোর গ্যাংকে চিহ্নিত করার কাজটি করে। একইসঙ্গে কিশোর ও অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতেও ক্রাইম ডিভিশন কাজ করছে।

কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শৈথিল্যও হতে পারে এর একটি বড় কারণ। এছাড়া সামনে জাতীয় নির্বাচন। হয়তো বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে কথিত রাজনৈতিক বড়ভাইরা তাদের ব্যবহার করছে। আমরা বিশ্বাস করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চেষ্টা করলে এক সপ্তাহের মধ্যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। ঠিকমতো নজরদারি করলে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা বন্ধ হবে। তবে অভিভাবকদের সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।

দুই তরুণ খুনে মূল হোতাসহ গ্রেফতার ৮ : সোমবার রাতে দুই তরুণ খুনের ঘটনায় মূল হোতা ইলিয়াছসহ ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। মঙ্গলবার আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম