প্রকল্প বাস্তবায়নে উন্নয়ন সহযোগী
কঠিন শর্তে ঋণের প্রস্তাব বাড়ছে
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কঠিন শর্তের ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব বাড়ছে উন্নয়ন সহযোগীদের। সম্প্রতি হাওড় উন্নয়নে অনমনীয় শর্তে ঋণ দিতে চাইছে ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট (ইফাদ)।
এতে আপত্তি জানিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। সেখানে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত ঋণটি উচ্চ অনমনীয় (কঠিন) শর্তের হওয়ায় এ ধরনের ঋণ গ্রহণ সমীচীন হবে না।
তাহলে অন্য উন্নয়ন সহযোগীরা পরবর্তী সময়ে একই ধরনের ঋণ দিতে উৎসাহিত হবে। এমন মতামত দিয়ে একটি চিঠি ইআরডির ফাবা (ফরেন এইড বাজেট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস) উইং থেকে পাঠানো হয়েছে সমন্বয় ও নরডিক অনুবিভাগে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
ইআরডি সূত্র জানায়, বর্তমানে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে চড়া সুদ কিংবা কঠিন শর্তের ঋণ প্রস্তাব আসছে। নি ম্ন আয়ের দেশ থেকে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাওয়ায় এ ধরনের ঋণ প্রস্তাব দিচ্ছে উন্নয়ন সহযোগীরা। সম্প্রতি রাজশাহী ওয়াসার একটি প্রকল্পের ঋণে নানা কঠিন শর্ত দিয়েছিল চীন। এমনকি প্রকল্প চলাকালীন চীনা কোনো নীতিমালাগত পরিবর্তন হলে কোনো শর্ত ছাড়াই নোটিশ দিয়ে সম্পূর্ণ অর্থায়ন বাতিলের ক্ষমতা চেয়েছে দেশটি। সেই সঙ্গে উচ্চ কমিটমেন্ট ও ম্যানেজমেন্ট (প্রতিশ্র“তি ও ব্যবস্থাপনা) ফি, কম ম্যাচুরিটি (মেয়াদ পূর্ণ) ও সহজপ্রাপ্যতা পিরিয়ড, অধিকার ও ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে চীনা আইন প্রযোজ্য হওয়া এবং যেকোনো সালিশ নিষ্পত্তির স্থান হিসাবে বেইজিং বলে উলেখ করে প্রস্তাব দিয়েছে দেশটি। কিন্তু এসব প্রস্তাবের বিষয়েও আপত্তি দিয়ে প্রস্তাব ফেরত পাঠায় ইআরডি।
এ প্রসঙ্গে ইআরডির সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী শফিকুল আযম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের দোহাই দিয়ে অনেকে কঠিন শর্ত চাপাতে চাইবে। কিন্তু এখনই বৈদেশিক ঋণে কঠিন শর্ত চাপানোর কোনো কারণ নেই। কেননা ২০২৬ সালের পর বাংলাদেশ যখন এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাবে তখন এসব কার্যকর হবে। এখন কোনো কোনো উন্নয়ন সহযোগী যদি অতি উচ্চ অনমনীয় শর্তে ঋণ দিতে চায় তা হলে সেটি নেওয়ার ক্ষেত্রে ভাবতে হবে। কেননা শুধু বৈদেশিক অর্থের জন্যই কঠিন শর্তে ঋণ নেওয়ার কোনো মানে নেই। এক্ষেত্রে যারা এমন প্রস্তাব দিচ্ছে তাদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া দরকার। কেন তারা অতি উচ্চ অনমনীয় ঋণ প্রস্তাব দিচ্ছে। পাশাপাশি ভাবতে হবে যে প্রকল্পের জন্য এমন কঠিন শর্তে ঋণ নেওয়া হবে সেটি থেকে রিটার্ন আসবে কি না। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধের মতো আয় আসবে কি না সেটিও দেখতে হবে।
সূত্র জানায়, ‘হাওড় ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড লাইভলিহুড ইমপ্র“ভমেন্ট প্রজেক্ট-ক্লাইমেন্ট অ্যাডাপসন অ্যান্ড লাইভলিহুড প্রটেকশন (এইচআইএলআইপ-সিএএলআইপি)’ প্রকল্পে কঠিন শর্তে ঋণ প্রস্তাব করেছে ইফাদ। এক্ষেত্রে ৩৩ মিলিয়ন বা প্রায় ৩৬৩ কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রস্তাবে বলা হয়েছে ৩৫ বছরে এটি পরিশোধ করতে হবে। গ্রেস পিরিয়ড বা রেয়াতকাল ধরা হয়েছে ১০ বছর। সুদের হারের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে সোফার সঙ্গে টোটাল স্প্রেড ফর ক্যাটাগরি-১ কান্ট্রি (১ দশমিক ০৬ শতাংশ) যোগ হবে। কিস্তি দিতে হবে ছয় মাস পর পর। এই ঋণে গ্র্যান্ট এলিমেন্ট (ঋণটি কোন ধরনের) মাইনাস ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ইআরডির ফাবা উইং প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করে বলেছে, গত ১৬ ফ্রেব্র“য়ারির হিসাবে সোফার রেট ছিল ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর সঙ্গে বাকি সুদ যোগ হলে শেষ পর্যন্ত সুদের হার দাঁড়াতে পারে ৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। গড় ঋণ পরিশোধের সময় এবং ঋণটির শর্ত বিবেচনায় এটির গ্র্যান্ট এলিমেন্ট অত্যন্ত কম। অর্থাৎ মাইনাস ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ফলে এাটিকে একটি উচ্চ অনমনীয় ঋণ হিসাবে বলা যায়। কেননা যেকোনো ঋণের গ্র্যান্ট এলিমেন্ট ২৫ শতাংশের কম হলেই সেটি অনমনীয় ঋণ বলা হয়। সেখানে এটি মাইনাসে চলে গেছে।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে. মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, দিন দিন আমাদের জন্য সহজ শর্তের ঋণ কমে আসবে। কেননা ইতোমধ্যেই নি ম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি আমরা। এরপর এলডিসি থেকেও বেরিয়ে যাওয়ার পথে। ফলে সহজ ঋণ কমে আসাটা স্বাভাবিক। আমাদের ধীরে ধীরে বাণিজ্যিক ঋণের দিকেই যেতে হবে। সেই সঙ্গে এমনিতেও বিশ্ব বাজারে ঋণ পরিস্থিতি ভালো নয়। যারা ঋণ দেবে তারাও অর্থ সংকটে থাকছে। এক্ষেত্রে আমাদের চেষ্টা করতে হবে যতটা সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া যায় ততটাই ভালো। পাশাপাশি বাংলাদেশকে ঋণ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রকল্প বাছাইয়ে সচেতন হতে হবে। উৎপাদনশীল প্রকল্পে বিদেশি ঋণ নিতে হবে। এক কথায় ঋণের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
ইফাদের ঋণটি পর্যালোচনায় আরও বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত আর্থিক প্রস্তাব ও প্রকল্পটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ঋণ প্রস্তাবটি উচ্চ অনমনীয়। সেই সঙ্গে এ ঋণের মাধ্যমে গ্রহণ করা প্রকল্পটি কোনো উচ্চ রাজস্ব আনয়নকারী প্রকল্প নয়। এছাড়া অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের বৈদেশিক অর্থায়ন বিষয়ে যে বিচক্ষণ নীতিমালা অনুসরণ করা হয় সেক্ষেত্রে এ ঋণটি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা অনমনীয় ঋণের মাধ্যমে উচ্চ রাজস্ব আহরণকারী প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং নমনীয় (সহজ শর্তের) ঋণের মাধ্যমে অন্যান্য কম রাজস্ব আহরণকারীর প্রকল্প বাস্তবায়ন করাই হচ্ছে ইআরডির নীতি। এসব বিবেচনায় প্রকল্পে প্রস্তাবিত ঋণটি নেওয়া ঠিক হবে না। এর ফলে অন্য উন্নয়ন সহযোগীরা পরে একই ধরনের ঋণ দিতে উৎসাহিত হবে। পাশাপাশি সহজ শর্তের নমনীয় ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে যাবে। এ ছাড়া ঋণ প্রস্তাবটি অতি অনমনীয় হওয়ায় এই ঋণ অনুমোদনের জন্য স্ট্যান্ডিং কমিটি অন নন কন্সেশনাল কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন হবে বলে মতামত দেওয়া হয়েছে।