Logo
Logo
×

শেষ পাতা

শহিদ মিনারে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে শেষ শ্রদ্ধা

ফুলে ফুলে ঢেকে গেল কফিন

রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘গার্ড অব অনার’ * দেহ দান নয়, আজ সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে দাফন

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ফুলে ফুলে ঢেকে গেল কফিন

বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বিনম্রচিত্তে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ।

বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন, বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং সাধারণ মানুষ পুষ্পমাল্য অর্পণ করে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। এরপর গার্ড অব অনার দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রদ্ধা জানানো হয় এই বীর সেনানীকে। সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বাদ জোহর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মরহুমের তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

এদিকে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দেহ দান করার কথা থাকলেও সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে পরিবার। এ ব্যাপারে দুটি প্রতিষ্ঠান অপরাগতা প্রকাশ করায় সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে আজ তাকে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন তার একমাত্র ছেলে বারিস চৌধুরী। ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে মঙ্গলবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান একাত্তরের ফিল্ড হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় আত্মনিয়োগকারী জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার কিছু পরে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কফিন কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে নেওয়া হয়। কফিনবাহী গাড়িটি শহিদ মিনারে আসার পর বীর মুক্তিযোদ্ধারা তার কফিন গাড়ি থেকে নামান। এরপর তারা সেটি বহন করে শহিদ মিনারের কাছে প্যান্ডেল টানিয়ে কালো কাপড় দিয়ে গড়া অস্থায়ী মঞ্চে নিয়ে যান। কফিনের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্ত্রী শিরিন হক, ছেলে বারিশ চৌধুরী, কন্যা মিষ্টি চৌধুরী, বোন আলেয়া চৌধুরী এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আলফাতুন্নেসা। তার গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনায় দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত চলে শ্রদ্ধা নিবেদন।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ফুল হাতে লাইন ধরে শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা শেষে সেখানে রাখা শোক বইয়ে স্বাক্ষর করেন তারা।

বিএনপির পক্ষ থেকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বীর এ মুক্তিযোদ্ধাকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানান। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন-বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, এজেডএম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম, কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, খায়রুল কবির খোকন, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, ইশরাক হোসেন প্রমুখ।

রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে শ্রদ্ধা জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের শিরিন আখতার, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সিপিবির শাহ আলম, রুহিন হোসেন প্রিন্স ও মঞ্জরুল আহসান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, গণফোরাম (মন্টু) সভাপতি মোস্তফা মহসীন মন্টু, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের রেজা কিবরিয়া, নুরুল হক নূর, ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ প্রমুখ।

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান, সাবেক উপাচার্য একে আজাদ চৌধুরী, কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার, অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার, নারী নেত্রী খুশী কবির, রাশেদা কে চৌধুরীসহ গণবিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট নাগরিকরাও কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন অনেক বৃদ্ধ এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাও।

সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর পর জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে রাষ্ট্রীয় সালাম ও সম্মান জানায় প্রশাসন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলও তাকে সালাম জানায়। ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অতিরিক্তি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হেদায়েতুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশের একটি সুজ্জিত দল ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করে। ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, সাদেক আহমেদ খানসহ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও তাকে সালাম জানান।

স্মৃতিচারণ : শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেকে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সবার একই কথা-এই মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন আদর্শ বাঙালি। উনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি শুধু সাধারণ মানুষের ডাক্তার নন, সাধারণ মানুষের জন্য অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। তাকে নিয়ে গর্ব করার অনেক বিষয় আছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরী এই জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান। তিনি স্পষ্টবাদী ছিলেন। দেশের জন্য, মানুষের জন্য কথা বলতে তিনি কখনও পিছপা হননি। তার এই চলে যাওয়ায় যে অপূরণীয় ক্ষতি ও শূন্যতা সৃষ্টি হলো সেটা আর পূরণ হওয়ার নয়।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, মানুষ হিসাবে তার গুণাবলী ছিল অনন্য। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আজীবন লড়াই করে গেছেন তিনি।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরী সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাস করতেন। তিনি আমাদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যত অগ্রসর হবে, ততই তার স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ছোট ভাই শহিদুল্লাহ চৌধুরী পরিবারের পক্ষ থেকে সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তৃতীয় জানাজা : কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর দুপুরে তার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখানে তার তৃতীয় জানাজা হয়। এতে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, রফিক শিকদার, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নূর, ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু ও লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান অংশ নেন।

জানাজার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে মরহুমের একমাত্র ছেলে বারিস চৌধুরী বলেন, ‘আমার বাবার সারা জীবনের ইচ্ছা ছিল তার দেহ দান করার। আমরাও তার সন্তান হিসাবে, তার পরিবারের সদস্য হিসাবে এই আশাটা ফুলফিল করতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল বাবার প্রতি সম্মান দেখিয়ে লাশে ছুরি লাগাতে রাজি হয়নি। এরপর আমাদের আসলে আর কিছু করার নেই। তাই আমরা কালকে (শুক্রবার) সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে তার লাশ দাফন করব।’ পরে সেখানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ছোট ভাই সাবেক রাষ্ট্রদূত নাজিমুল্লাহ চৌধুরীও বক্তব্য দেন।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জানাজার পর লাশ অ্যাম্বুলেসে নিয়ে যাওয়া হয় ধানমন্ডি নগর হাসপাতালে। সেখানে চতুর্থ জানাজা হয়। এরপর লাশ নেওয়া হয় সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। আজ সকাল ১০টা থেকে জুমার আগ পর্যন্ত সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য লাশ সেখানে রাখা হবে। বাদ জুমা আরেক দফা জানাজা শেষে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান ফটকের বাম পাশে সমাহিত করা হবে জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তানকে।

এর আগে বৃহস্পতিবার সকালে বারডেম হাসপাতালের হিমঘর থেকে তার লাশ নেওয়া হয় ধানমন্ডির বাসায়। সেখানে প্রথম জানাজা হয়। এরপর লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে নেওয়া হয়। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শ্রদ্ধা জানানোর পর সেখানে আরেক দফা জানাজা হয়। এরপর লাশ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে নেওয়া হয়।

আইনমন্ত্রীর শোক : জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। এক শোকবার্তায় মুক্তিযুদ্ধকালে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়ন ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তুলে চিকিৎসা সেবায় জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিশেষ অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন তিনি।

খুলনা বিএনপির শোক : খুলনা ব্যুরো জানায়, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন খুলনা বিএনপির নেতারা। তারা হলেন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল, জাতীয় নির্বাহী কমিটির তথ্য বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, খুলনা মহানগর আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনা, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমীর এজাজ খান, মহানগর সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মনিরুল হাসান বাপ্পি প্রমুখ। এছড়া জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন সাদাকা-হাকন লিমিটেডের চেয়ারম্যান এইচএম নাসির উদ্দিন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম