সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনা
নিহত বাংলাদেশির সংখ্যা বেড়ে ১৮ পরিবারে কান্না
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ওমরাহ করতে যাওয়ার পথে সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ জনে।
সৌদি আরবের জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের প্রথম সচিব (শ্রম) আরিফুজ্জামান এ তথ্য জানান।
এদিকে বাংলাদেশে এসব প্রবাসীদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। স্বজনদের বিলাপে ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস। অকস্মাৎ এমন ঘটনায় স্বজনদের কোনোভাবেই সান্ত্বনা জানাতে পারছেন না এলাকাবাসী।
কারও বাবা, কারও মা, কারও স্ত্রী-সন্তান শেষবারের মতো একনজর দেখতে চাইছেন তাদের প্রিয়জনকে। তাই তারা লাশ দেশে ফিরিয়ে আনার অনুরোধ জানিয়েছেন। স্বজনরা জানান, নিহতদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার খেটে খাওয়া পরিবারের সন্তান। পরিবারে সচ্ছলতা আনার লক্ষ্যে তারা সৌদি আরব পাড়ি জমান।
এদিকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমেদ এ ঘটনায় শোক জানিয়েছেন। তিনি জানান, সৌদি আরবের জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট এবং শ্রম কল্যাণ উইংয়ের কর্মকর্তারা দুর্ঘটনার সংবাদ শোনার পর থেকেই তাদের পাশে থেকে সার্বক্ষণিক প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছেন।
তিনি বলেন, নিহতদের পরিবারকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সরকারি বিধি অনুযায়ী আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। নিহতরা হলেন-নোয়াখালীর সেনবাগের শরিয়তউল্লাহর ছেলে শহিদুল ইসলাম, কুমিল্লার মুরাদনগরের আব্দুল আউয়ালের ছেলে মামুন মিয়া, নোয়াখালীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন, লক্ষ্মীপুরের সবুজ হোসাইন, কুমিল্লার মুরাদনগরের রাসেল মোল্লা, কক্সবাজারের মহেশখালীর মো. আসিফ, গাজীপুরের টঙ্গীর আব্দুল লতিফের ছেলে মো. ইমাম হোসাইন রনি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার কালু মিয়ার ছেলে রুকু মিয়া, কক্সবাজারের মহেশখালীর শাফাতুল ইসলাম, কুমিল্লার দেবিদ্বারের গিয়াস হামিদ, যশোরের কোতোয়ালির মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, যশোরের রনি, কক্সবাজারের রামু উপজেলার কাদের হোসাইনের ছেলে মোহাম্মদ হোসেন। এ ছাড়া খাইরুল ইসলাম, রুহুল আমিন, তুষার মজুমদার, মিরাজ হোসাইন ও সাকিবের বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি। যুগান্তরের ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
কুমিল্লায় তিন প্রবাসীর বাড়িতে মাতম : ওই দুর্ঘটনায় নিহতদের একজন মুরাদনগর উপজেলার রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের মোস্তফাপুর গ্রামের মামুন মিয়া (২৮)। মামুনের মা মমতাজ বেগম জানান, তার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলতে বলতে বাসটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। ছেলের এমন মৃত্যুর দৃশ্য ভুলতে পারছেন না তিনি। রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া বলেন, দ্রুত যেন লাশ দেশে এসে পৌঁছায় সেই দাবি জানাই। তাছাড়া আহতদের যেন যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়। এদিকে হারপাকনা গ্রামের আব্দুল মালেকের ছেলে ইয়ার হোসেন (৩০), রাজনগর গ্রামের জজ মিয়ার ছেলে জাহিদ হাসান (২৩) গুরুতর আহত হয়ে সাউদি আরবের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। দুর্ঘটনায় একই উপজেলার রাসেল মোল্লা নামে আরেক প্রবাসী নিহত হয়েছেন। তবে তার গ্রাম এবং পরিবারের সঠিক তথ্য এখনো নিশ্চিত করা যায়নি।
এদিকে ওই দুর্ঘটনায় নিহত দেবিদ্বার উপজেলার রাজামেহার গ্রামের গিয়াস হামিদের (৩৭) পরিবার উপার্জনক্ষম একমাত্র আপনজনকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান। গিয়াস হামিদ রাজামেহার গ্রামের আব্দুল হামিদের ছেলে। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, আমরা নিহত প্রবাসীদের পরিবারের পাশে থাকব। তাদের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ রাখব।
রায়পুরে সবুজের বাড়িতে আর্তনাদ : লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চরমোহনা ইউনিয়নের দক্ষিণ রায়পুর গ্রামের সবুজ হোসাইনের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে বাবা-মায়ের কান্না থামছে না। বাবা হারুন জানান, তিনি মাছ বিক্রি করে সংসার চালান। প্রায় ৩ বছর আগে বড় ছেলে সবুজকে ধারদেনা করে সৌদি আরব পাঠান। সেখানে তিনি একটি খাবার হোটেলের শ্রমিক হিসাবে কাজ করতেন।
টঙ্গীর রনির স্ত্রীর আরজি : ‘আমি অন্তত আমার স্বামীর লাশটি ফেরত চাই; তাকে একনজর দেখে শেষ বিদায় দিতে চাই; আমার আর কিছু রইল না, আমি আমার অবুঝ শিশু সন্তানকে নিয়ে কোথায় যাব’-এমনিভাবে আহাজারি করছিলেন ইমাম হোসাইন রনির (৪৫) স্ত্রী শিমু আক্তার (৩৫)। পাশেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল রনির একমাত্র ছেলে ইসমাইল হোসাইন (১০)। রনির বাবা আব্দুল লতিফ (৭০) ছেলে হারিয়ে অঝোরে কাঁদছেন। ছোট ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা মনে করে তার বড় বোন হাজেরা খাতুন স্বপ্না বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। মা আলিমুন্নেছা ২০২০ সালে মারা যান। রনির ছোট ভাই হোসাইন আহমেদ জসিম জানান, চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জে তাদের গ্রামের বাড়ি। টঙ্গীর বড় দেওড়া জামে মসজিদ রোডে বাড়ি করে দীর্ঘদিন ধরে তারা সপরিবারে বসবাস করে আসছিলেন। তিন ভাই, এক বোনের মধ্যে রনি দ্বিতীয়। রনি দেওড়া এলাকায় টেইলার্স ও মুদি দোকানদারি করতেন। ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় ভাগ্য বদলের আশায় পাড়ি জমান সৌদি আরবে। ৮ বছর ধরে সৌদি আরবে একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন তিনি। দুই মাস আগে ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। ছুটি কাটিয়ে ২৫ মার্চ সৌদি আরব যান।
নোয়াখালীর শহীদুল ও হেলালের বাড়িতে শোক : নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ মোহাম্মদপুর গ্রামের শরীয়ত উল্যা জসিমের ছেলে শহীদুল ইসলাম (২৬) ও চাটখিল উপজেলার রামনারায়ণপুর ইউনিয়নের পশ্চিম রামনারায়ণপুর গ্রামের ভূঁইয়াজি বাড়ির হুমায়ন কবিরের ছেলে হেলাল উদ্দিন (৩৪) মারা যান। শহীদুল ইসলামের চাচা জয়নাল আবেদিন বলেন, গত বছরের রমজানের মাঝামাঝি সময় সৌদি আরবে যান শহীদুল। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে শহীদুল ছিল সবার বড়। সৌদিতে গিয়ে সেখানে একটি কোম্পানিতে চাকরি করত সে। হেলাল উদ্দিনের ছোট ভাই মোহাম্মদ রিপন বলেন, গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরবের আবহা জেলায় যান হেলাল উদ্দিন। সেখানে একটি কোম্পানীতে চাকরি নেন তিনি। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন হেলাল। তিন বছর বয়সি হাজাবি নামের একজন কন্যা সন্তান রয়েছে তার।
মহেশখালীতে দুই খালাতো ভাই নিহত : দুর্ঘটনায় কক্সবাজারের মহেশখালীর মোহাম্মদ শেফায়েত ও মোজাম্মদ আসিফ নামের দুই যুবক নিহত হয়েছেন। তারা সম্পর্কে খালাত ভাই। মোহাম্মদ আসিফ বড় মহেশখালীর পূর্ব ফকিরাঘোনা গ্রামের আহমদ উল্লাহর ছেলে এবং মোহাম্মদ শাফায়েত বড় ডেইল এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে। তারা সৌদি আরবের আল বাহা ডিস্ট্রিকে মেইনটেন্সের কাজ করার সুবাদে কাছাকাছি থাকতেন।
নিহত শ্যালক-দুলাভাই, পটুয়াখালীতে শোক : সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে মোজাম্মেল হোসাইনের (৪৫) বাড়ি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার ছৈলাবুনিয়া গ্রামে। নিহত অপর বাংলাদেশি সাগর জোমাদ্দার, সম্পর্কে নিহত মোজাম্মেলের শ্যালক। তার বাড়ি বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের বটতলা গ্রামে।
যশোরের নাজমুলের বাড়িতে মাতম : যশোর সদর উপজেলার ঘুনী গ্রামের কাওসার মোল্লার ছেলে নজরুল ইসলাম নাজমুল (২৮)। প্রায় এক বছর আগে প্রবাসে পাড়ি দেন এই রেমিট্যান্স যোদ্ধা। নাজমুল হোসেন ৭ ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম। একবছর আগে সৌদি আরব যান নাজমুল। সৌদি আরবের আভা কামিম শহরের একটি রেস্তোরাঁতে ওয়েটার ছিলেন তিনি। বুধবার দুপুরে নাজমুলের বাড়িতে দেখা গেছে হৃদয়বিদারক দৃশ্য।
রুক্কু মিয়ার কসবার বাড়িতে আহাজারি : সাত ভাই বোনের অভাবের সংসারে রুক্কু মিয়া (৪০) বড় হয়েছে। দেশে সে রিকশা চালাত। পরিবারের সচ্ছলতার কথা ভেবে প্রায় তিন বছর আগে সৌদি আরবের আল কাসিমে পাড়ি জমান। শিগগিরই তার দেশে ফেরার কথা ছিল। গ্র্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় চলছে শোকের মাতম। রুক্কু মিয়া কসবা উপজেলার কায়েমপুর ইউনিয়নের ওমরপুর গ্রামের মৃত কালা মিয়ার ছেলে। তিনি বাবা-মায়ের ৭ সন্তানের মধ্যে ৫ম। তিনি ২ ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের জনক।