সংকট মোকাবিলায় খোঁজা হচ্ছে বৈদেশিক ঋণ
১৫৪ প্রকল্পে দরকার ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা
অগ্রাধিকারের তালিকা চূড়ান্ত করেছে পরিকল্পনা কমিশন * উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে ইআরডি
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আর্থিক সংকট মোকাবিলায় বৈদেশিক ঋণে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সহজ ও কঠিন যে কোনো শর্তের উৎস থেকেই এই ঋণ পেতে চায় সরকার। ১৫৪টি উন্নয়ন প্রকল্পের একটি অগ্রাধিকার তালিকা করেছে পরিকল্পনা কমিশন। এর মধ্যে উচ্চ অগ্রাধিকারে আছে ১২৫টি, মধ্যম অগ্রাধিকারে ২৮ এবং নিম্ন অগ্রাধিকারে একটি প্রকল্প।
এগুলো বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। এজন্য বৈদেশিক ঋণ দরকার এক লাখ ৩২ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। বাকি টাকা সরকারি খাত থেকে যাবে। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে ঋণ পেতে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। তবে ঋণের অর্থ ব্যবহারে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান রোববার যুগান্তরকে বলেন, বৈদেশিক অর্থায়নের জন্য তালিকাভুক্ত প্রকল্পগুলোকে আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি। সরকারের অগ্রাধিকারের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগীদের অগ্রাধিকার মিলে গেলে তারা ঋণ দেওয়ার জন্য উৎসাহী হবে। তাদের সামনে আমাদের চাওয়াটা তুলে ধরেছি। এখন কোন কোন প্রকল্পে ঋণ পাওয়া যাবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চলমান সংকট মোকাবিলায় আমাদের প্রচুর অর্থায়ন দরকার। পাশাপাশি এই অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে আমরা সচেতন।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার সুবিধার্থে অনুমোদনহীন এসব নতুন প্রকল্পের জন্য সব ধরনের ঋণের সম্ভাব্য উৎস হিসাবে ধরা হয়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সহজ শর্তের ঋণ হিসাবে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থাকে (জাইকা) ধরা হয়েছে। পাশাপাশি অনমনীয় শর্তের চীন, ভারত, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) এবং কোরিয়াসহ বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীদের কথা ভাবা হচ্ছে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব তালিকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এটি যুক্ত করা হচ্ছে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি)। তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সাধারণ সরকারি সেবা খাতে প্রকল্প রয়েছে চারটি। এছাড়া জনশৃঙ্খলা ও সুরক্ষায় পাঁচটি, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবায় পাঁচটি, কৃষিতে ১১টি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ২২টি এবং পরিবহণ ও যোগাযোগ খাতে ২৭টি প্রকল্প। আরও আছে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে সাতটি, পরিবেশ-জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদে ১২টি, গৃহায়ন ও কমিউনিটিতে ৩২টি, স্বাস্থ্যে ছয়টি, ধর্ম-সংস্কৃতি ও বিনোদনে চারটি এবং শিক্ষায় ১৩টি প্রকল্প। বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে তিনটি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে তিনটি এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতে রয়েছে তিনটি প্রকল্প।
ইআরডির সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী শফিকুল আযম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এই অগ্রাধিকার তালিকা থাকা মানেই হচ্ছে সামনে একটা লক্ষ্য আছে। ফলে পরবর্তী সময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের সুবিধা হয়। তবে আগামীতে পরিকল্পনা কমিশনের উচিত হবে ইআরডির বরোইং প্ল্যানের (ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা) সঙ্গে সমন্বয় করে এ ধরনের তালিকা করা। তাহলে সেটি আরও বেশি কার্যকর হবে। তিনি বলেন, বর্তমান সংকটময় সময়ে যেহেতু ডলারের ওপর চাপ বাড়ছে, সেহেতু উন্নয়ন প্রকল্পে নমনীয় ঋণ যত বেশি আসবে ততই ভালো হবে। তবে যে ধরনের ঋণই আসুক না কেন, তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। অর্থাৎ ঋণের টাকা যেন উৎপাদনশীল প্রকল্পে খরচ করা হয়।
সূত্র জানায়, সাসটেইনেবল অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পটির জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ হিসাবে ১০ হাজার কোটি এবং সরকারি তহবিল থেকে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য রয়েছে। ঋণ পাওয়া গেলে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে শুরু করে ২০২৮ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। এছাড়া বাপবিবোর (বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড) বৈদ্যুতিক বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও ক্ষমতা বর্ধন (চট্টগ্রাম-সিলেট বিভাগ)।
প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ৯৯৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ থেকে পাঁচ হাজার ৫২১ কোটি এবং সরকারি তহবিল থেকে এক হাজার ৬২৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয় হবে। ঋণ মিললে ২০২৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। উচ্চ অগ্রাধিকারে থাকা বাপবিবোর বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও ক্ষমতা বর্ধন (রাজশাহী-রংপুর বিভাগ) প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫৫৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ থেকে তিন হাজার ৬৩৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা খরচের লক্ষ্য রয়েছে।
জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান সংকটের সময় যত বেশি বৈদেশিক ঋণ পাওয়া যাবে ততই ভালো। এ তালিকা থাকায় সুবিধা হলো সরকারের পক্ষ থেকে কি চাওয়া হচ্ছে সেটি বোঝা যায়। ইআরডি এই তালিকার সঙ্গে মিল রেখে ঋণ খোঁজার কাজটা করতে পারে। তবে এ ধরনের তালিকায় সব সময় মনে রাখতে হবে দেশের বাস্তব প্রয়োজনে যেন প্রকল্প নেওয়া হয়। ঋণের টাকা যেন কার্যকরভাবে খরচ করা যায়। ইআরডির একটি সূত্র জানায়, বৈদেশিক ঋণ খোঁজার ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনে তালিকাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বা দেশকে অনুরোধ করাও হয়েছে।