আদানির সঙ্গে দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল করুন :-মির্জা ফখরুল
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
ভারতের বৃহৎ ব্যবসায়ী গ্রুপ আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চুক্তির সমালোচনা করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আদানির সঙ্গে চুক্তি দেশবিরোধী, জনগণের স্বার্থবিরোধী এবং দূরভিসন্ধিমূলক। আদানির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, পুরো বিষয়টি সরকার গোপন রেখেছে। লুট আর লুট, এখানে আর কিছু নেই। এ চুক্তি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।’
বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন। ‘মহাবিপর্যয়ে বিদ্যুৎ খাত : গভীর খাদে অর্থনীতি’ শীর্ষক এ আলোচনার আয়োজন করে অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (অ্যাব)। এতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন অ্যাবের মহাসচিব প্রকৌশলী হাছিন আহমেদ।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) আইন বাতিল করতে হবে। এ খাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সবাইকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এসব দুর্নীতির তদন্ত করা হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই অবৈধ সরকার সর্বোচ্চ লুটের জন্য পরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতকে বেছে নিয়েছে। আদানির সঙ্গে চুক্তি শুধু অসম নয়, দুরভিসন্ধিমূলকও। বিভিন্ন দেশে এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমন চুক্তিতে কীভাবে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করল?’
চুক্তিটিতে রাজনৈতিক উপাদান আছে বলে মনে করেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘চুক্তিটি হয়েছে ২০১৭ সালে, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে। সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের পার্লামেন্টে বলা হয়েছে, এটা কি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ঘুষ দেওয়া হয়েছে?’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সরকার আখের গোছানোর জন্য শুধু বিদ্যুৎ খাত নয়, সব খাতে দুর্নীতি করছে। তারা টাকা দিয়ে নির্বাচন কিনে নেবে। যারা নির্বাচন পরিচালনা করেন, তাদের সবার কাছে তারা নগদ টাকা পৌঁছে দেয়। নির্বাচন কমিশন এটা স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু প্রিজাইডিং অফিসার থেকে শুরু করে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সব জায়গায় খাম চলে যায়। পুলিশের কাছে খাম যায়, বিজেবির কাছে খাম যায়। এমনকি স্ট্রাইকিং ফোর্স যারা থাকে তাদের কাছেও খাম যায়। এটা সত্য, যা ঘটেছে ২০১৮ সালে।’
প্রতি নির্বাচনে সরকার নতুন নতুন কৌশল বেছে নেয় বলে মন্তব্য করেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘এ সরকার খুব সৃজনশীল। আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর শুনি। তারা বলছেন, পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে আগের মতো তো পারা যাচ্ছে না। তাই নির্বাচনে কারচুপির নতুন কৌশল নিয়েছে। এবার পুলিশ বাদ দিয়ে আনসার ভিডিপি ব্যবহারের কৌশল নিয়েছে। জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কোনো কিছু তারা করতে পারে না। ১৪ বছর ধরে প্রতারণা করে যাচ্ছে। একটা দিন ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল জনগণের, সেটাও তারা কেড়ে নিয়েছে।’
১০টি গ্রুপ ৫০ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এসব গ্রুপ সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী, তারা ৫০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। তারা হলো সামিট, ইউনাইটেড, এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল, বাংলা ক্যাট, ওরিয়ন, আরপিএসএল, এফবিসিএল, মোহাম্মদী গ্রুপ, হোসাফ গ্রুপ, ডরিন। এরা সবাই এই শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত।’
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের চরম দুরবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিএনপির মহাসচিব। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই উলেখ করে তিনি বলেন, ‘এই সরকারকে পদত্যাগ করার জন্য বাধ্য করতে হবে। এজন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
গোলটেবিল আলোচনায় বেশ কিছু লিখিত সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে-বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন বাতিল করতে হবে; বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে; রেন্টাল/কুইক রেন্টাল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি নবায়ন বন্ধ/বাতিল করতে হবে; অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন স্থাপন করতে হবে যাতে ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদান কমানো যায়; সংকট মোকাবিলায় পেট্রোবাংলা, বাপেক্স ইত্যাদি সরবরাহকারী সংস্থার মাধ্যমে দেশীয় খনিজ কয়লা ও গ্যাস উত্তোলনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে দেশীয় প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তুলতে উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে; দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে টেকসই ও নিরাপদ করতে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা কমিয়ে ক্রমান্বয়ে মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তিনির্ভর জ্বালানি নীতি গ্রহণ করতে হবে। অবৈধ ও অস্বচ্ছ টেন্ডারবিহীন বিদ্যুৎ চুক্তি বাতিল করতে হবে, ক্ষেত্র বিশেষে চুক্তি সংশোধন করে দেশের স্বার্থরক্ষা করতে হবে; দেশের শিল্পকারখানা/বাণিজ্যিক/ আবাসিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিদ্যুতের চাহিদা নিরূপণ করে আগামী ২৫ বছরের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র, সঞ্চালন লাইন ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের ধারাবাহিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে; বিদ্যুৎ সেক্টরের সব ক্রয়/বণ্টন চুক্তির পূর্ণ তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে; বিদ্যুৎ খাতের সব চুক্তি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করে করতে হবে; বর্তমানে দেশে বার্ষিক বিদ্যুৎ চাহিদা বৃদ্ধির পরিমাণ ৫-৭%, সেই হিসাবে আগামী ৫-৭ বছরে দেশে নতুন কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন নেই, বরং বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সংস্কার ও বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের মাধ্যমেই বর্তমান সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
অ্যাবের সভাপতি প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম রিজুর সভাপতিত্বে ও যুগ্ম মহাসচিব কেএম আসাদুজ্জামান চুন্নুর সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন-সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্য সচিব কাদের গনি চৌধুরী, সাবেক সংসদ-সদস্য আবদুস সোবহান, শাম্মী আখতার, অ্যাবের আশরাফ উদ্দিন বকুল, শাহজাহান আলী, গোলাম মাওলা, মোস্তফা-ই-জামান সেলিম, একেএম জহিরুল ইসলাম জহির, নিয়াজ উদ্দিন ভুঁইয়া, শাহাদাত হোসেন বিপ্লব, সুমায়েল মুহাম্মদ, মাহবুবুল আলম, মো. হানিফ প্রমুখ।