বিমান পাইলটের জাল সনদের তদন্ত শুরু
৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন : তিন কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে হবে * চাকরিচ্যুত হতে পারেন ক্যাপ্টেন সাজিদ * ট্রেনিং পরীক্ষায় বারবার ফেল করায় বিমানের গচ্চা কয়েক কোটি টাকা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিমানের চিফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন সাজিদ আহমেদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে। তিনি প্রভাব খাটিয়ে স্ত্রীসহ দুজনকে জাল সার্টিফিকেট দিয়ে পাইলট নিয়োগ দিয়েছেন। একই সঙ্গে অদক্ষ ও অযোগ্য পাইলট নিয়োগ দিয়ে ট্রেনিংয়ের নামে সংস্থাটির কয়েক কোটি টাকার বেশি অর্থ গচ্চা দিয়েছেন।
এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বিমানের ফ্লাইট অপারেশন্স পরিচালক ক্যাপ্টেন সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে সোমবার এই কমিটি গঠন করা হয়। অপর দুই সদস্য ফ্লাইট সেফটি বিভাগের প্রধান ক্যাপ্টেন ইনাম তালুকদার ও ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং তাপস আহমেদ। কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটনমন্ত্রী এম মাহবুব আলী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঘটনার সত্যতা পেলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একটি অভিযোগ সামনে এলে সেটার সত্য-মিথ্যা দেখতে হবে। কিছু হলে তো অভিযুক্তকে সুযোগ দেওয়ারও বিধান আছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশবাসীও চায় বিমান ভালো চলুক। যেসব অভিযোগ আসে, এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ব্যবস্থাও নিই।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির এক সদস্য যুগান্তরকে জানান, প্রাথমিক তদন্তে তারা ক্যাপ্টেন সাজিদের বিষয়ে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন। এই নিয়োগের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও তাদের কাছে আছে। তাছাড়া করোনাকালীন ক্যাপ্টেন সাজিদ নিজের স্ত্রী সাদিয়াকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বানিয়ে বিমানের সঙ্গে কার্গো ব্যবসা করেছেন। এই ব্যবসা করতে গিয়ে তারা বিমানের যাত্রী কেবিনে কার্গো পণ্য বহন করে ৮টি উড়োজাহাজের বড় ধরনের ক্ষতিসাধন করেছেন। কমিটির এই সদস্য বলেন, পাইলট নিয়োগে ক্যাপ্টেন সাজিদের যে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তাতে তিনি চাকরিচ্যুত হতে পারেন। একইভাবে চাকরিচ্যুত হতে পারেন তার স্ত্রী ক্যাপ্টেন সাদিয়া ইসলামসহ কমপক্ষে ৫ জন পাইলট। ক্যাপ্টেন সাদিয়া ইসলাম ও ক্যাপ্টেন মেহেদী আল ইসলাম জাল সার্টিফিকেট দিয়ে নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সাম্প্রতিক এক তদন্তে জানা যায়, সাদিয়া ইসলাম নিয়োগের সময় জাল শিক্ষাগত সনদ জমা দিয়েছেন। ওই জাল সনদ অনুযায়ী তিনি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন বিজ্ঞান শাখা থেকে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তিনি শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজ থেকে মানবিক শাখা থেকে দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছিলেন।
সিএএবির নিয়ম অনুযায়ী, বাণিজ্যিক পাইলটদের বাধ্যতামূলকভাবে পদার্থবিজ্ঞান, গণিতসহ এইচএসসি বা সমমানের সনদ থাকতে হবে। কিন্তু সাদিয়া পাশ করেছেন মানবিক বিভাগ থেকে। শুধু বিমানেই নয়, এর আগেও সাদিয়ার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ ছিল। এসব অভিযোগে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ও জিএমজি এয়ারলাইন্স থেকেও তিনি চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন।
অপরদিকে জাল এয়ারলাইন্স ট্রান্সপোর্ট পাইলট লাইসেন্স (এটিপিএল) জমা দেওয়ায় ফার্স্ট অফিসার আল মেহেদী ইসলামের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। পাইলট ইন কমান্ড হতে হলে এই সনদ প্রয়োজন হয়। মেহেদী এটিপিএল লাইসেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় ১৪টি পরীক্ষার মধ্যে ১১টিতেই অংশ নেননি এবং যে ৩টিতে অংশ নিয়েছিলেন, এর মধ্যে ২টিতে উত্তীর্ণ হতে পারেননি।
জানা যায়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তড়িঘড়ি করে ১৪ জনকে পাইলট হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ এক বছর পর তাদের মধ্যে মাত্র পাঁচজনের নিয়োগ চূড়ান্ত হয়। অন্যরা জাল সার্টিফিকেট, অযোগ্যতা, লাইসেন্সিং পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত। এই এক বছরে পাইলটদের প্রশিক্ষণ ও বেতন মিলিয়ে কয়েক কোটি টাকার বেশি অর্থ খরচ করে কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, নিয়োগপ্রাপ্ত পাইলটদের মধ্যে সাদিয়া ইসলাম বিমানের চিফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন সাজিদ আহমেদের স্ত্রী। অভিযোগ আছে, সাজিদের চেষ্টা-তদবিরেই নিয়োগ পান তার স্ত্রী। এমনকি প্রভাব খাটিয়ে আÍীয়স্বজনকেও বিমানে নিয়োগ পাইয়ে দিয়েছেন ক্যাপ্টেন সাজিদ। এ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য বিমানের চিফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন সাজিদ আহমেদের সঙ্গে যুগান্তর থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। দফায় দফায় কল করেও তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি। স্ত্রী সাদিয়া ইসলামের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি।
বিমানের ফ্লাইট অপারেশন্স বিভাগ সূত্রে জানা যায়, অপারেশন ম্যানুয়াল অনুযায়ী বিমানের বোয়িং ৭৭৭-এর ফার্স্ট অফিসার হতে হলে কমপক্ষে ৩০০ ঘণ্টার ফ্লাইং অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। কিন্তু নিয়োগপ্রাপ্তদের কারোরই সেই অভিজ্ঞতা ছিল না।
১৩ ফেব্রুয়ারি বিমানের এক চিঠিতে দেখা যায়, নিয়োগ পাওয়া ১৪ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জন ক্যাপ্টেন এবং ১ জন ফার্স্ট অফিসার সিমুলেটরসহ সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। অপরদিকে ক্যাপ্টেন সাদিয়া ইসলামকে বিমানের খরচে কমপক্ষে পাঁচবার সুযোগ দেওয়া হলেও তিনি কৃতকার্য হতে পারেননি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, পাইলটদের মধ্যে অনেকে বারবার সিমুলেটর পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হতে না পারলেও তাদের বেতনভাতাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছিল বিমান। অথচ আগে কখনো এভাবে বেতনভাতা দেওয়া হতো না।
বেতন দেওয়া প্রসঙ্গে বিমানের এক নথিতে বলা হয়েছে ক্যাপ্টেন সাদিয়াসহ সংশ্লিষ্ট পাইলটরা তাদের প্রথম প্রশিক্ষণ ফ্লাইট সম্পন্ন করেছেন। তারা বিমানের হজ ফ্লাইট অপারেশনে বিশাল অবদান রেখেছেন এবং তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া এটি সম্ভব হতো না। তাই প্রশিক্ষণের অধীনে থাকলেও তারা নিয়মিত পাইলটদের মতোই ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন। এই অবদান বিবেচনা করে তাদের বেতন প্রথম প্রশিক্ষণ ফ্লাইট তারিখ থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই নথিতে স্বাক্ষর করেছেন বিমানের সাবেক এমডি যাহিদ হোসেনসহ ৪ জন পরিচালক। সাদিয়ার বেতন স্লিপে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুলাইয়ে তার মোট আয় ছিল ১২ লাখ ৬৩ হাজার টাকা।
নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে শুধু চুক্তিই উপেক্ষা করা হয়নি, তাদের মোটা অঙ্কের বেতন দেওয়ার পাশাপাশি নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হয়েছিল, যা ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২১ সালে নিয়োগ পাওয়া পাইলটরা পাননি।
জাল সনদ প্রসঙ্গে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শফিউল আজীম সাংবাদিকদের বলেন, কেউ যদি তথ্য গোপন করে এবং সেটি যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনিয়ম করে পার পেয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।