একা হয়ে পড়ছে আওয়ামী লীগ
চাপে দুই শরিক দল নির্লিপ্ত অন্যরা
দুদকের মামলায় অস্বস্তিতে বিকল্পধারা ও তরিকত ফেডারেশন * মামলা-মোকদ্দমার নামে যা হচ্ছে তা অনভিপ্রেত-রাশেদ খান মেনন * আ.লীগ শরিকদের প্রয়োজন মনে করে কিনা-এমন প্রশ্ন দিলীপ বড়ুয়ার
শেখ মামুনুর রশীদ
প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চাপের মুখে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের দুই শরিক দল-বিকল্পধারা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলার জালে আটকে পড়ায় অস্বস্তিতে আছে এই দল দুটির শীর্ষ নেতারা। এ নিয়ে ইতোমধ্যে তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী এমপি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এখন মুখ খুলেছেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের দুই শীর্ষ নেতা মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান এমপি এবং মাহী বি. চৌধুরী এমপি।
যদিও এসব ঘটনায় নির্লিপ্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের বাকি শরিক দলগুলো। তাদের মতে, নানান কারণে এমনিতেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটের শরিকদের টানাপোড়েন চলছে। দিন দিন দূরত্ব বাড়ছে। এর মধ্যে এ ধরনের মামলা-মোকদ্দমা প্রমাণ করে ক্ষমতাসীনরা ক্রমেই একা হয়ে পড়ছে। অবশ্য আওয়ামী লীগ এখন শরিকদের প্রয়োজন মনে করে কিনা-এমন প্রশ্নও তুলেছেন ১৪ দলীয় জোটের কেউ কেউ।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি রোববার যুগান্তরকে বলেন, মামলা-মোকদ্দমার নামে যা হচ্ছে তা অনভিপ্রেত। এসবের সুখকর কোনো ফলাফল নেই। তিনি আরও বলেন, সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি তাকে কী বলব বুঝতে পারছি না। তবে এটুকু বলতে পারি, এসব ঘটনায় মানুষ মনে করছে আওয়ামী লীগ ক্রমেই একা হয়ে পড়ছে।
আওয়ামী লীগের আরেক শরিক সাম্যবাদী দলের (এমএল) সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ১৪ দলীয় জোট আছে কিনা-তাই তো জানি না। কিছু দিবস পালন করা ছাড়া এই জোটের কাজ কী তাও বুঝি না। আসলে আওয়ামী লীগ এখন আর শরিকদের প্রয়োজন মনে করে কিনা-সেটাই বড় প্রশ্ন।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী দুই ছেলেসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করে দুদক। এর আগে দুদক গত ২৬ জানুয়ারি একই অভিযোগে বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান ও তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মান্নান এবং তাদের দুই মেয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে। একই দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাহী বি চৌধুরী এবং তার স্ত্রী আশফা হক লোপার বিরুদ্ধে আমেরিকায় অর্থ পাচারের অভিযোগ এনে ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর তাদের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ দেয় দুদক।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকারের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী এবং তরিকতবিরোধী ও সহি মতবাদবিরোধী অপশক্তি মিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার দূরত্ব সৃষ্টি করতে চায়। এর অংশ হিসাবেই দুদককে দিয়ে আমার দুই ছেলের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করা হয়েছে। এই মামলার মূল টার্গেট আমার দুই ছেলে নয়, টার্গেট মূলত আমি।’
তিনি আরও বলেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চলছে। এটা অনেকদিন ধরেই চলছে। ৪০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ইতোমধ্যে ৬৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আয়কর নথিতেও এ বিষয় উল্লেখ আছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে অর্থ আত্মসাৎ বা অর্থ পাচারটা হলো কীভাবে। আমি আইনিভাবেই বিষয়টিকে মোকাবিলা করব। ইতোমধ্যে দুদকের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি। প্রকাশ্যেই তুলেছি। দুদক আমার কাপড় ধরে টান দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, আমি তাদের ছাড় দেব না। আমি শুধু জনপ্রতিনিধি নই। আমি লাখ লাখ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করি।
সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, আসলে আমি স্বাধীনতাবিরোধীদের বিষয়ে প্রথম থেকেই সোচ্চার। পাকিস্তানি বাহিনী মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশে যে গণহত্যা চালিয়েছে, তার বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘে কাজ করছে আমার ছেলে। এসব একটি পক্ষের সহ্য হচ্ছে না। তাই ভিন্ন কৌশলে তারা ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কথা হয়েছে। তিনি আমাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন। আমি সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব।
বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান এমপি রোববার যুগান্তরকে বলেন, আমাকে এবং আমার পরিবারকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে হেয় করতে এ ধরনের একটি একতরফাভাবে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এসবের পেছনে অবশ্যই কেউ না কেউ আছে। তা না হলে এ ধরনের একটি মামলা করার সাহস দুদক পায় কোথায়। সময় এলে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত বলব। এই মামলার সঙ্গে রাজনৈতিক কোনো সম্পর্ক আছে কিনা-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্যই। আমি যে আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছি। সেখান থেকে যাতে আগামীতে আর নির্বাচন করতে না পারি, জোট থেকে মনোনয়ন না পাই-এ রকম চেষ্টা তো একটি পক্ষ অনেকদিন ধরে করে আসছে।
মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট গঠন করে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচন করেছি। আমি এবং আমাদের দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাহী বি. চৌধুরী দুটি আসন থেকে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছিল, আমাদের দুজনেরই একটি পরিচ্ছন্ন অতীত আছে। আমাদের রাজনীতি অত্যন্ত পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। আমরা হাওয়া ভবনের দুর্নীতির প্রতিবাদ জানিয়ে বিএনপি থেকে বেরিয়ে এসে অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে বিকল্পধারা বাংলাদেশ গঠন করেছি। দুর্নীতি করে অর্থ আয় করতে চাইলে তো ওই সময় বিএনপির সঙ্গে থাকলেই হতো। দল থেকে বেরিয়ে আসার দরকার হতো না।
তিনি বলেন, পেছনে একটি অপশক্তি কলকাঠি নাড়ছে। ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চলছে। জোটের শরিকদের ভেতরে আস্থাহীনতা, অবিশ্বাস-এসব তৈরি করার জন্য নেপথ্যে কেউ হয়তো কাজ করছে। আমরা আইনিভাবেই মামলা-মোকদ্দমা মোকাবিলা করব।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বিকল্পধারা বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাহী বি. চৌধুরী এমপি যুগান্তরকে বলেন, আমাদের দলের মহাসচিব মেজর (অব.) আব্দুল মানান ও তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মান্নান এবং তাদের দুই মেয়েসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে তা অনেক পুরোনো। নতুন করে এটি সামনে আনা হয়েছে। তার নিজের এবং স্ত্রী আশফা হক লোপার সম্পদের হিসাব চেয়ে দুদকের নোটিশ দেওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহী বি. চৌধুরী বলেন, ‘কেউ একজন হয়তো তাদের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ করেছে। দুদক তা খতিয়ে দেখতে আমাদের সম্পদের হিসাব চেয়েছে। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাই সম্পদের হিসাব দিয়েছি। দুদক তাদের অনুসন্ধানে কোথাও কোনো অনিয়ম পায়নি।’
প্রসঙ্গত, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাদের দীর্ঘদিনের শরিক ১৪ দল এবং প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে নিয়ে মহাজোট গঠন করে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে এই জোটে আওয়ামী লীগের সঙ্গে শরিক হয় আরেক সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট।
ওই নির্বাচনে (দশম জাতীয় সংসদ) আসন সমঝোতার অংশ হিসাবে বিকল্পধারা বাংলাদেশকে দুটি আসনে ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ। একটি লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে দলটির মহাসচিব মেজর (অব.) আব্দুল মান্নানকে। আরেকটি মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরীকে। দুজনই জয়ী হন ওই নির্বাচনে। কাগজে-কলমে মহাজোট বলে এখন আর কিছু নেই। তবে বিকল্পধারা বাংলাদেশ এখনো রয়ে গেছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান এবং মাহী বি. চৌধুরী।
একইভাবে ১৪ দলীয় জোটের শরিক হিসাবে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনকে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুটি আসনে ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ। একটি চট্টগ্রাম-২ আসনে দলটির চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীকে। আরেকটি লক্ষ্মীপুর-১ আসনে দলটির সাবেক মহাসচিব লায়ন এমএ আউয়ালকে। নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা জয়ী হন। পরে তরিকত ফেডারেশন ছেড়ে একই নামে নতুন দল গঠন করায় লায়ন এমএ আউয়ালকে আর আসন ছাড় দেয়নি আওয়ামী লীগ। তবে আসন ছাড় পেয়ে সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী নৌকা প্রতীক নিয়ে পরপর আরও দুবার (দশম ও একাদশ) সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।