Logo
Logo
×

শেষ পাতা

মহান ভাষার মাস

একুশের বইমেলা আত্মপরিচয়ের অবিনাশী চেতনা

Icon

কামাল চৌধুরী

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একুশের বইমেলা আত্মপরিচয়ের অবিনাশী চেতনা

আজকাল চেতনা কথাটি আমরা সব সময় ব্যবহার করি। মনে করা হয় চেতনা মানে এক ধরনের বিশ্বাস, বোধ ও প্রত্যয়, যা হৃদয়ে লালন করা হয়। এটি চেতনার মনোজাগতিক দিক-কিন্তু চেতনার একটি দৃশ্যমান দিকও আছে। যেটির বহিঃপ্রকাশ ঘটে ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে, আন্দোলন সংগ্রাম ও জীবনাচরণে শিল্প-সাহিত্যে।

একুশের চেতনাও সেরকম একদিকে আজ ত্যাগের চেতনা, সাহসের চেতনা-অন্যদিকে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা উন্নয়ন ও বিকাশের অভিপ্রায় অঙ্গীকার বাঙালি হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ও এ চেতনার অংশ।

বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার রক্তাক্ত আন্দোলনের ফলে ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরু থেকেই এর মূল উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়। বাংলাভাষা ও সাহিত্যে উন্নয়ন ও বিকাশ। ১৯৫৭ সালে ‘দ্য বেঙ্গলি একাডেমি অ্যাক্ট’র মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানকে আইনগত ভিত্তি দেওয়া হয়। আইনটি ইংরেজিতে প্রণীত-এতে বলা হয়েছিল-An Act to promote the culture and development of Bengali language and literature-পরবর্তী সময়ে যেসব আইন বা অধ্যাদেশ জারি হয়েছে তাতে একাডেমির কার্যপরিধিতে নতুন বিষয় সংযোজন হলেও লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসাবে বাংলাভাষার উন্নয়ন ও বিকাশের বিষয়টি উল্লেখ আছে।

বর্ণিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে সাধনের জন্য বাংলা একাডেমি বহুবিধ কাজ সম্পাদন করলেও বাংলা একাডেমিতে বইমেলার আয়োজন শুরু হয় বেসরকারি প্রচেষ্টায় ১৯৭২ সালে। মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা সে সময় বর্ধমান হাউজের সামনে কিছু বই সাজিয়ে এই মেলার শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে বাংলা একাডেমি গ্রন্থমেলা আয়োজনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। বর্তমানে বইমেলা বিশাল আকার ধারণ করেছে। পরিণত হয়েছে বাঙালির সৃজন ও মনন চর্চার স্নায়ুকেন্দ্র।

পৃথিবীতে অনেক বইমেলা হয়। এ মেলাগুলোর মূল উদ্দেশ্য থাকে গ্রন্থ প্রদর্শন ও বিক্রয়। অনেক আন্তর্জাতিক বইমেলা হয় যেখানে বিভিন্ন দেশের প্রকাশকরা তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। তবে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা ব্যতিক্রম-সেখানে খুচরা বই বিক্রি হয় না। বরং প্রকাশনা ও বিক্রয়সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য আলোচনা ও চুক্তি সম্পাদন হয়ে থাকে। এছাড়া বই বিক্রির লক্ষ্যে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন দেশে অনেক মেলা হয়।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এটি আন্তর্জাতিক বইমেলা নয়। এর চরিত্রের সঙ্গে বাঙালির আবেগ, সৃজন ও মননশীলতা জড়িয়ে আছে। এখানে লেখক ও পাঠকের যে সম্মিলন ঘটে সেটি শুধু নিছক ক্রয়-বিক্রয়ের ঘটনা নয়। এর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক চেতনার মেলবন্ধন ঘটে। প্রতিবছর একুশের গ্রন্থমেলায় অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়, যা আমাদের লেখকদের যেমন বৃহত্তর পাঠক সমাজে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে তেমনি আমাদের প্রকাশনা শিল্পকেও দৃঢ়ভিত্তি দিচ্ছে।

সবচেয়ে বড় কথা এ বইমেলার মাধ্যমে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য সংরক্ষণের এবং এর উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য সবচেয়ে দৃশ্যমান কাজটি সম্পাদিত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অভূতপূর্ব বিকাশের কারণে দেশে দেশে, মানুষে মানুষে দূরত্ব কমে এসেছে। এর ফলে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সহজ সুযোগও তৈরি হয়েছে। এর একটি নেতিবাচক দিক হচ্ছে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক ধরনের আত্মপরিচয়ের সংকটও তৈরি হচ্ছে। ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসনে সম্ভাবনাও এখন অনেক বেশি।

বলা হয়, পৃথিবীতে প্রায় ৭০০০ ভাষা আছে। এর মধ্যে অনেক ভাষা বিপন্ন-ক্রমাগত বিলুপ্ত হচ্ছে অনেক ভাষা। ভাষা বেঁচে থাকে জনগণের মুখে আর শিল্প-সাহিত্যে। যে ভাষার চর্চা বেশি সে ভাষা স্বমহিমায় টিকে থাকে। বাংলাভাষা তার সাহিত্য সম্পদের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের একটি বিপুল অংশ বাংলাভাষা ও সাহিত্যচর্চা থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাভাষার প্রসার ও বিকাশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার জন্য আরও ব্যাপক কাজ করা দরকার। বাংলা একাডেমির অমর একুশের গ্রন্থমেলা বাংলাভাষা ও সাহিত্যচর্চায় সৃজনশীল প্রেরণা হিসাবে কাজ করে। বইমেলা বাঙালির আত্মপরিচয়ের চেতনার অংশ।

অনুলিখন : শুচি সৈয়দ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম