Logo
Logo
×

শেষ পাতা

মহান ভাষার মাস

বইমেলা ‘স্থিতিজড়তা’ও অবসান ঘটাক

Icon

হাসান হাফিজ

প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বইমেলা ‘স্থিতিজড়তা’ও অবসান ঘটাক

একুশের চেতনা নিয়ে শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই কেন শোরগোল হবে? বছরের অন্য মাসগুলোতে কেন নয়? এই প্রশ্ন অতীব প্রাসঙ্গিক।

এখন কোনো ঔপনিবেশিক শাসনের নিগড়ের অধীন আমরা নেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, অনেক বছর পার হয়ে গেল।

সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন আজও অব্দি কেন হলো না? এর দায় বা দোষ তাহলে কাদের? সেসব তো আমরা চিহ্নিত সেভাবে করিনি। আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে আমাদের আন্তরিকতা, সদিচ্ছা ও অঙ্গীকারের ঘাটতি আছে।

এক ধরনের হীনম্মন্যতা যাকে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় আমরা বলতে পারি, ‘স্থিতিজড়তা’ তার কবল থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব হয়নি। প্রবঞ্চনামূলক ও প্রতিহিংসার রাজনীতির শঠতা, প্রকৃত গণতন্ত্রেও অনুপস্থিতি এ জন্য দায়ী বলে আমার মনে হয়। মুষ্টিমেয় কয়েকজনের চিৎকার-চেঁচামেচিতে সর্বস্তরে বাংলা চালু করা যাবে না। সমস্যাটি সর্বাংশেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। ভাষার সঙ্গে অর্থনীতির সুদৃঢ় মেলবন্ধন ঘটাতে না পারলে অতি জটিল এই সমস্যা চিরকাল যে তিমিরে ছিল, থেকে যাবে সেই তিমিরেই। মাতৃভাষার মাধ্যমে না হলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। এই মহার্ঘ কথা বহু বহু আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহরা বলে গেছেন। পরিতাপ ও দুর্ভাগ্য, আমরা তা থেকে যথার্থ শিক্ষা নিইনি।

বাংলা মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর কর্মসংস্থানের সম্মানজনক নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে সর্বাগ্রে। সেটা যদি না করা যায়, তাহলে তরুণরা এতে আগ্রহী কেন হবে? যদি ঠিকঠাকমতো তাদের চৈতন্যোদয় ঘটত, তাহলে আমাদেরকে এই আফসোস করতে হতো না। অন্যভাষার প্রতি আমাদের কোনো বিরাগ বা বিদ্বেষ নেই। থাকা উচিতও নয়। এখন আমরা একটি গ্লোবাল ভিলেজে বাস করি। পৃথিবী নামের পুরো গ্রহই এখন নেটওয়ার্কের আওতায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সেই অসম্ভবকে সম্ভবপর করে তুলেছে। সেই সুবিধা আমরা কতখানি নিতে পারছি? কতটা মাতৃভাষা বাংলার কল্যাণ ও বিকাশ সাধনে সচেষ্ট হতে পারছি? বহুভাষিক সমাজ কেন এখনো হলো না? এইসব আত্মজিজ্ঞাসার সময় কি এখনো হয়নি? ডিজিটাল ডিজিটাল বলে আমরা হইচই করছি, গলা ফাটিয়ে ফেলছি, সেই ডিজিটাল জগতে বাংলা ভাষার ঠাঁই প্রকৃত অর্থে ঠিক কতখানি? এই প্রশ্নও তো তোলা যেতে পারে। শহিদের রক্তমাখা স্মৃতিজড়ানো বাংলা তো এতটা অচ্ছুত, ফেলনা ও দুর্বল কাঠামো-ঐতিহ্যের ভাষা নয় যে, তাকে ডিজিটালি উপস্থাপন ও সহজে ব্যবহার উপযোগী করা যাবে না!

স্বাধীনতার পর বাংলা পরিভাষা নিয়ে যথেষ্ট কাজ হয়েছিল। সে গতি এখন আর নেই। কবে কোন্ কুক্ষণে চোরাগোপ্তা ভাটা এসে কেড়ে নিয়ে গেছে সেই আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার স্রোতধারা। এমনকি স্বৈরাচারী এরশাদ আমলেও গুরুত্ব সহকারে বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন মনিটরিং সেল ক্রিয়াশীল ছিল। পরিভাষা প্রণয়নের কাজটি সমাপ্ত হয়নি। আশির দশকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির এসিআরে একটা ভালো নম্বর বরাদ্দ ছিল বাংলা ভাষার জন্য। নিত্যদিনের দাপ্তরিক কাজকর্মে কে কতখানি বাংলা ভাষা ব্যবহার করছেন, সেটার মূল্যায়ন করা হতো। এখন সেটির দস্তুর বোধহয় আর নেই। উবে গেছে কর্পূরের মতো। আদি দৈনিক বাংলা পত্রিকার রিপোর্টার হিসাবে এই বিষয়টি আমার অল্পবিস্তর জানা। হয়তো না জানাই ছিল ভালো! না জানা থাকলে এ বিষয়ক মনোকষ্ট থেকে মুক্তি মিলত।

২.

ঢাকাই তো বাংলাদেশ নয়। একুশের বইমেলা শুধু ঢাকায় কেন হবে? কেন দেশের অন্যান্য অঞ্চলে নয়? ঢাকার বাইরে যারা বসবাস করেন, তাদের কি অপরাধ? যে তরুণ মনপুরা উপজেলায় পড়াশোনা করে, কিংবা বাংলাবান্ধায় কিংবা সুসং দুর্গাপুরে কিংবা টেকনাফে সে কি চট করে ঢাকায় আসতে পারে? পারে না। সেজন্যে বইমেলাকে ছড়িয়ে দিতে হবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। উপজেলা পর্যায়ে এখনই নেওয়া সম্ভব নয়। প্রথমত বিভাগীয় শহরগুলোতে আয়োজন করা তো সম্ভব। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা, আন্তরিকতা ও অঙ্গীকার। জেলায় জেলায় শিল্পকলা একাডেমি আছে। শিশু একাডেমির শাখা আছে। তাদের জায়গা আছে। সেসব অফিস চত্বরে বইমেলার আয়োজন করা যায়। সামগ্রিক সংস্কৃতির বিকাশে শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমিকে সম্পৃক্ত করে নিলেই হয়। জেলা প্রশাসন এই কাজটা তত্ত্বাবধান করুক। বছরে একবারই তো মাত্র।

জেলায় জেলায় এক সময় বইমেলার আয়োজন করা হতো। তা সাফল্যের মুখও দেখেছিল। সেই চল উঠে গেছে কোন্ কবে! ভালো কোনো জিনিসকে আমরা ধরে রাখতে পারি না। হয়তো চাইও না। আমরা বাণিজ্য মেলা নিয়ে যত উৎসাহী, বইমেলা নিয়ে ততোটা হই না।

এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত। মান্ধাতার আমল আর নেই। বইকে পাঠকের ক্রেতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। একটু চেষ্টা, একটু পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সৃজনশীল বইয়ের জগৎ উপকৃত হতে পারে। জাতির মনন মজবুত হতে পারে তাতে। কাগজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সৃজনশীল গ্রন্থ প্রকাশের অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছে। এ এক নতুন অশনি সংকেত। এই নতুন সংকট মোকাবেলায় সরকারি কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। একুশের বইমেলা আমাদের সব রকম সামাজিক ‘স্থিতিজড়তা’র অবসান ঘটাক এটাই কামনা।

অনুলিখন : শুচি সৈয়দ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম