মহান ভাষার মাস
সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনে দায় যেমন রাষ্ট্রের দায় আমাদেরও
অসীম সাহা
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফেব্রুয়ারি মাস। ভাষার মাস। কোন্ ভাষার মাস? বাংলা ভাষার? দিন-মাস-বছরের হিসাবে হয়তো বাংলা ভাষার মাস হিসাবে তাকে চিহ্নিত করা যেতেই পারে। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে ইতিহাসের সত্যের যে দূরত্ব, সারা বছর বাংলা ভাষার দুর্দশা দেখে আমরা খুব জোর গলায় তাই এই মাসকে ভাষার মাস বলতে পারি না।
ভাষা আন্দোলনের যে প্রধান অঙ্গীকার, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন, তা কি সত্যিই আমরা করতে পেরেছি? অফিস-আদালতে, সংবাদপত্রে-বেতার-টেলিভিশনে, রাস্তাঘাটে, মানুষের চলনে-বলনে যে বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে, তাকে বলা যেতে পারে এক ধরনের জগাখিচুড়ি ভাষা।
এই ভাষার জন্যই ১৯৫২ সালে সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বার প্রমুখ জীবন দিয়েছিল? এখন সর্বক্ষেত্রে যে ধরনের ভাষার ব্যবহার হচ্ছে, দেখে-শুনে মনে হয়, যেন শহিদদের ব্যঙ্গ করার জন্যই তা হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবাদপত্র, বেতার-টেলিভিশন এবং আমাদের প্রকাশিত গ্রন্থাবলি একটি সুশৃঙ্খল, সহজ ও সাবলীল ভাষা ব্যবহার করবে, এটা সবারই কাম্য ছিল। কিন্তু এখন যে ধরনের ভাষার ব্যবহার হচ্ছে, তা না হচ্ছে প্রমিত, না হচ্ছে সবার জন্য সহজবোধ্য বাংলা ভাষা।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এর দায় যেমন রাষ্ট্রের, তেমনি সুশীল সমাজেরও। তারা প্রতিনিয়ত যেখানে শুদ্ধ ও প্রমিত বানান ব্যবহারের ক্ষেত্রে উদাসীনতা ও অজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছেন এবং আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলা ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার কথা বলে লাভ নেই। প্রমিত ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে যে একটি মৌলিক বাংলা ব্যাকরণ রচনার প্রয়োজন ছিল, তা আজও রচিত হয়নি।
বাংলা ব্যাকরণের নামে আমরা সংস্কৃত ব্যাকরণের বাংলাকৃত নকল বই পাঠ করছি। বাংলা অভিধানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যেসব সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ওপর এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারা সম্পূর্ণরূপে না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর ফলে ভাষার ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য চলছে, তা অব্যাহত থাকলে বাংলা ভাষার বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠবে।
সন্দেহ নেই, ভাষার মাসে প্রতিদিনই বাঙালি উৎসব-আনন্দের আমেজের মধ্য দিয়ে এক ধরনের বিনোদন লাভ করেন। বিভিন্ন ধরনের সেমিনার, আলোচনাসভা, সংগীতানুষ্ঠানসহ নানা ধরনের আয়োজন করা হয়।
সেমিনার-সিম্পোজিয়ামগুলোতে রাশভারী আলোচনা-অনুষ্ঠান চলে। কিন্তু বাংলা ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে যেসব প্রস্তাবনা আসে, ভাষার মাস চলে গেলে সেসব প্রস্তাবনা হিমঘরে চলে যায় কী করে? বাংলা ভাষার মনন ও উৎকর্ষের প্রতীক বাংলা একাডেমি যে উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এই প্রতিষ্ঠান কি এখন সেই উদ্দেশ্য যথাযথভাবে পালন করছে? আর ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বাংলা ভাষার জন্য দৃৃশ্যমান কী কাজ করে, তা জানতে গেলে সম্ভবত অনুসন্ধান কমিটি কিংবা গোয়েন্দা সংস্থা নিয়োগ করতে হবে।
এটা বেদনার কথা, যেসব শহিদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এসেছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও তারই প্রচলনের জন্য আবার দাবি তুলতে হবে, হাইকোর্টকে নির্দেশনা দিতে হবে এবং আমাদের বেদনাদগ্ধ হৃদয়ের আর্তি প্রকাশ করতে হবে, সেটা কল্পনা করতে গেলেও লজ্জায় আমাদের মাথা নত হয়ে আসে। কিন্তু লজ্জা নেই তাদের, যারা এ নিয়ে টালবাহানা করেন এবং ক্রীতদাস মানসিকতা নিজেদের ভেতরে লালন করেন।
আমরা জানি, অবহেলার কারণে অতীতে পৃথিবী থেকে বহু ভাষার বিলুপ্তি ঘটে গেছে এবং এখনো প্রতিনিয়ত ঘটছে। পৃথিবীর একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা হওয়া সত্ত্বেও এই অবহেলা বাংলা ভাষাকে একটি বিপজ্জনক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে। এই বিপর্যয়ের ইঙ্গিত লক্ষ করা সত্ত্বেও আমাদের উদাসীনতা বিস্ময়কর।
এখনো সময় আছে, নিজেদের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করলে বাংলা ভাষা আত্মরক্ষার একটি সুযোগ পেতে পারে। ভাষার মাস, আমাদের সবচেয়ে গৌরবের মাস ফেব্রুয়ারিতে আমরা শপথ গ্রহণ করি এবং ভাষাশহিদদের আত্মত্যাগের মহিমাকে যেন আমরা ভূলুণ্ঠিত না করি, এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
অনুলিখন : শুচি সৈয়দ