মহান ভাষার মাস
একুশ প্রথম প্রতিবাদ সাহসের বাতিঘর প্রজন্মপরম্পরায়
মাকিদ হায়দার
প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমি তখন অনেক ছোট। আমরা থাকতাম পাবনা শহরের জিলাপাড়া মহল্লার দোতলা বাড়িতে। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। আর পাবনা মুসলিম লীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক। সেদিন তিনি শহরের কাজকর্ম দ্রুত সেরে বাড়িতে এসে মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, রোফ (জিয়া হায়দার) কোথায়? মা বললেন, আজিজদের বাড়িতে গিয়েছে। তৌফিক আজিজ খান ছিলেন জিয়া ভাইয়ের স্কুল-বন্ধু।
বাবা মাকে বললেন, এইমাত্র শুনে এলাম, মন্ত্রী নুরুল আমিনের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। ছেলেদের দাবি ছিল-বাংলা ভাষাই রাষ্ট্রভাষা থাকবে। ছেলেরা জিন্নাহ সাহেবের কথা মানে নাই। আমার অল্প শিক্ষিত মা শুধু বাবার কাছে জানতে চাইলেন, জিন্নাহ সাহেব তো পাকিস্তান বানালেন। বাবা হ্যাঁ বলার পর মা বললেন, তাহলে ছাত্রদের গুলি করে মারা হলো কেন? বাবা জানালেন, জিন্নাহ চেয়েছিলেন পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা হবে উর্দু।
১৯৪৮ সালে জিন্নাহ ঢাকায় দুই জায়গায় বক্তৃতায় ওই একই কথা বলেছেন। প্রথম দিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে। দ্বিতীয় দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে। দুই স্থানেই ছাত্ররা প্রতিবাদ জানিয়েছে।
-সত্যিকার অর্থে আমাদের এই ভূখণ্ডে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রতিবাদ।
২.
পাকিস্তান হওয়ার পরে নুরুল আমিন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং তারই হুকুমে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মিছিলে গুলি করে পুলিশ। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি আমাদের জিলাপাড়ার বাড়িতে অনেক লোক এলেন। বাবা ছিলেন পাবনা শহর মুসলিম লীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক। আর সভাপতি ছিলেন কৃষ্ণপুরের খবির উদ্দিন। বাড়ির নিচতলায় ঘরে বসে অনেকেই দুঃখপ্রকাশ করলেন। শোকপ্রকাশ করলেন না খবির উদ্দিন।
তিনি জানালেন, জিন্নাহ সাহেবের কথা না শুনে ছাত্ররা ভুল করেছে। খবির উদ্দিনের কথায় কেউ তাকে সমর্থন না দিয়ে প্রচণ্ড বাগ্বিতণ্ডা শুরু হলো। গোপাল, আকবর আলী শুধু বললেন, ‘ছাত্রনেতা শেখ মুজিব থাকলে...’। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই খবির বললেন, ‘মুজিবর তো জেলে।’ আরেকজন বললেন, জেলে নয়, ছাত্রদের মিছিলে তিনিও ছিলেন। আমাদের জিলাপাড়ার বাড়ির বাসার ঘরেই মুসলিম লীগ দুইভাগ হলো। একজন জানালেন, ‘খবির উদ্দিন মিয়াকে পাবনা মুসলিম লীগের নেতা আজ থেকে মানি না।’ আমার বাবাকে একজন বললেন, আপনি সবার সামনে ঘোষণা দিন আজ থেকে আপনি আর পাবনা মুসলিম লীগের অর্থ সম্পাদক থাকছেন না। বাবা জানিয়ে দিলেন, ‘আমি অর্থ সম্পাদক থাকছি না।’
আমাদের বসার ঘরে আজিজ ভাই, জিয়া ভাই এরা নুরুল আমিনের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে স্লোগান দিলেন। যতদূর মনে পড়ে-১৯৫৩ অথবা ১৯৫৪ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের একদল ছাত্র ২১ ফেব্রুয়ারিতে মাতৃভাষার মিছিল করার অপরাধে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। তাদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রনেতা আব্দুল মতিন, রণেশ মৈত্র, কামাল লোহানী, জিয়া হায়দার, শাহজাহান মাহমুদ, প্রসাদ রায়, আমিনুল ইসলাম বাদশা প্রমুখ। কৃষ্ণপুর, রাধানগর, জিলাপাড়া ও শালগাড়িয়ার বেশ কয়েকজন ছাত্রও গ্রেফতার হন।
মনে আছে, আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। ১৯৬৫ সালে ঐতিহাসিক ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলন নিয়ে অনেক আলোচনা হয় পাবনার বনমালী ইনস্টিটিউটে। ছাত্রনেতা আব্দুল মতিন হাজার হাজার লোকের মাঝে বক্তব্য রাখেন। মতিন ভাই এবং রণেশ দা বলেছিলেন, ‘বাঙালির মাতৃভাষা হবে বাংলা।’
-জেলজুলুম সহ্য করেও ন্যায়ের পক্ষে থাকা একনিষ্ঠ আদর্শবান আপসহীন এই মানুষগুলো ছিলেন আমাদের কাছে সাহস ও সংগ্রামের অনুপ্রেরণা, অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।
৩.
যতদূর মনে পড়ে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. মাযহারুল ইসলাম প্রথম বইমেলার অনুমতি দিয়েছিলেন ‘মুক্তধারা’ প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহাকে। বাংলা একাডেমির বটতলায় মাটিতে চটের ওপর বই বিছিয়ে চিত্তরঞ্জন সাহাই প্রথম বইমেলা করেছিলেন। সেই থেকে শুরু ২১ ফেব্রুয়ারির বইমেলা, যা এখন আমাদের প্রাণের উৎসব।
-এই একুশের বইমেলাই ‘একুশের চেতনা’কে লালন করছে, ধারণ করছে, পৌঁছে দিচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।
অনুলিখন : শুচি সৈয়দ