ইউসুফ আলীর ওপর ন্যক্কারজনক হামলা
ক্ষোভ অসন্তোষে ফুঁসছেন কয়েকশ সাবরেজিস্ট্রার
আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শিগগির, প্রতিকার না হলে ফের কর্মবিরতি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
হামলার শিকার সাবরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলী (ইনসেটে)।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে সাবরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীর ওপর ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনায় সারা দেশে সাবরেজিস্ট্রাররা ক্ষোভে ফুঁসছেন। বেশিরভাগ সাবরেজিস্ট্রার কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে এখনো অনড়। তবে আইনমন্ত্রী অ্যাড. আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দ্রুত প্রতিকার করার আশ্বাস দেওয়ায় রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সবাইকে শান্ত থেকে জনস্বার্থে আপাতত কাজ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। শিগগির এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন নেতাদের সঙ্গে আইনমন্ত্রীর বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এরপর তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাবেন।
প্রসঙ্গত, গত ১০ জানুয়ারি সাবরেজিস্ট্রার নিজ দপ্তরে হামলার শিকার হন। বেলা সাড়ে ৩টায় ১০-১২ জন লোক হাতে লাঠি ও পাইপ নিয়ে এজলাস কক্ষে প্রবেশ করে সাবরেজিস্ট্রারকে পেপার ওয়েট, পানির গ্লাস, লাঠি ও পাইপ দিয়ে মাথার পেছন দিকে এলোপাতাড়িভাবে আঘাত করে। গুরুতর অবস্থায় তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এ ঘটনায় সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের মোহরার মামুন অর রশিদ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছেন। পুলিশ সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তিনজন মুহুরিকে গ্রেফতার করেছে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খান যুগান্তরকে বলেন, ‘তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারি না। পুলিশও তদন্ত করছে। তদন্ত শেষ হলেই জানা যাবে কারা হামলা চালিয়েছে এবং কেন এই ঘটনা ঘটেছে।’
বাংলাদেশ রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অহিদুল ইসলাম এবং মহাসচিব এস এম শফিউল বারী রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘কর্মস্থলে তাদের সহকর্মীর ওপর এ ধরনের হামলা শুধু নিন্দনীয় নয়, এটা নজিরবিহীন। প্রায় পাঁচশ সাবরেজিস্ট্রারসহ দেশের প্রতিটি রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সের কোনো কর্মী এটি মেনে নিতে পারছেন না। প্রত্যেকের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ অসন্তোষ বিরাজ করছে। তবে আইনমন্ত্রীর আশ্বাসে সবাই নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো বিবেকবান মানুষ এ ধরনের হামলা মেনে নিতে পারে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ‘মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর পরবর্তী পদক্ষেপের কথা বলতে পারবেন।’
এদিকে এ ঘটনায় সংক্ষুব্ধ সাবরেজিস্ট্রারদের কয়েকজন যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতি ও জনহয়রানির অভিযোগ এনে অনেকে ইউসুফ আলীর ওপর কালিমা লেপনের চেষ্টা করছেন। এটাও আর এক ধরনের অপরাধ ও মানহানির পর্যায়ে পড়ে। কেননা, কেউ আদালত কৃর্তক দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দুর্নীতিবাজ বলা বেআইনি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, স্থানীয় প্রশাসন ছাড়াও প্রভাবশালী একটি মহল ইউসুফ আলীর কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিতে ব্যর্থ হয়ে এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। তারা বলেন, কারা হামলাকারীদের উসকানিদাতা এবং পেছন থেকে ইন্ধন দিয়েছেন তদন্ত করে তাদেরকে প্রত্যেককে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এছাড়া শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল হায়াত ঘটনার দিন দুুপরে সাবরেজিস্ট্রারের দপ্তরে গিয়ে ইউসুফ আলীর প্রতি অসম্মান আর তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা ছাড়াও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন। তারা বলেন, এ সময় সাবরেজিস্ট্রারকে তুইতোকারি করে কে গালি দেন সেটি অবশ্যই তদন্ত হবে। কথাকাটাকাটি ও গালাগালাজের অডিও রেকর্ড সবার কাছে রয়েছে। অডিও রেকর্ডে এসব শুনে সবাই বিস্মিত হয়েছেন। এ ধরনের অপমান ও অসম্মান কোনোভাবে মেনে নেওয়া হবে না।
যে অডিও ভাইরাল ‘থাপড়াইয়া দঁাঁত ফালাইয়া দিমু... বাচ্চা, ও পাইছেটা কী? আমরা আসছি, অ্যাকাউন্টস অফিসার আসছে, তা ওর হচ্ছে না। অ্যাকাউন্টস অফিসার দায়ী হবে ও দায়ী হবে না। ...পাইছোটা কী? (লেখার অযোগ্য খারাপ উক্তি)...বাচ্চা জড়ো হয়েছে এখানে।’ সাবরেজিস্ট্রার শিবগঞ্জ বলেন, ‘এক বছরে এই উপজেলা থেকে ২৬ কোটি টাকা আদায় করেছি। প্রতিউত্তরে একজন বলেন, ‘২৬ কোটি টাকা তুমি নিয়ে গেছ। চোরের চোর কোথাকার, একটা চোরের এতবড় গলা হয় কী করে। দুইটা ভাই। দুইটা উপজেলায় চুরি করে শেষ করছে।’ প্রতিউত্তরে সাবরেজিস্ট্রার বলেন, ‘আপনি পরিবার নিয়ে কথা বলবেন না। আমি অফিসার না? জবাবে বলা হয়, ‘কিসের অফিসার তুমি? একটা পিয়ন হওয়ার যোগ্যতা নাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা অপদার্থ দিয়েছে।’ এ সময় উপস্থিত কয়েকজন সাবরেজিস্ট্রারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি বলেন, স্যার আমার ভুল হয়ে গেছে।’ প্রতিউত্তরে সাবরেজিস্টার শিবগঞ্জ বলেন, ‘কিসের ভুল? প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দেব।’ এ সময় তাকে বলা হয়, ‘তুই ছেড়ে দিয়ে চলে যা।’ সাবরেজিস্ট্রার বলেন, ‘আপনি অফিসার, আমিও অফিসার।’ ইউএনও বলেন, ‘কিসের অফিসার তুমি? একটা পিয়ন হওয়ার যোগ্যতা নাই।’ সাবরেজিস্ট্রার বলেন, ‘আপনি ফার্স্ট ক্লাস অফিসার, আমিও ফার্স্ট ক্লাস অফিসার। এটা কোয়াশি জুডিশিয়ারি পোস্ট।’ এ সময় তাচ্ছিল্যের সুরে বলা হয়, ‘কোয়াশি জুডিশিয়ারি?’ সাবরেজিস্ট্রার প্রতিউত্তরে বলেন, ‘এমনি এজলাস দিছে। ইউএনও বলেন, ‘এমনি ওই এজলাস বানানো যায়। কেমন ক্ষমতা দেখি, একজনকে জেল দাও, দাঁত একটাও থাকবে না, জুডিশিয়ারি বানিয়ে রাখছ।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনও আবুল হায়াত রোববার সন্ধ্যায় যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, ‘প্রতিবন্ধী মেয়ের প্রাপ্য পেনশনের ব্যবস্থা যথাসময়ে নিশ্চিত না করায় দুপুর একটায় তিনিসহ উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে যান। এ সময় সাবরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলামকে মারতে উদ্যত হন। তিনি কোনো বাজে মন্তব্য করেননি। গালিগালাজ করেননি। বকাঝকা করেছেন।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে : অভিযোগ ওঠে নিজ দপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মচারীর পেনশনের টাকার ফাইল ১৫ মাস ধরে আটকে রেখেছিলেন ইউসুফ আলী। মৃত কর্মচারীর নাম আবু তালেব। তার প্রতিবন্ধী মেয়ে রুবাইয়া ফারাইয়া ইয়াসমিন (১৮) যেন পেনশনের টাকাটা পায়, সেজন্য দিনের পর দিন ঘুরছিলেন তার খালা সলেনূর বেগম। তিনি যুগান্তরেক বলেন, ‘গত ১৫ মাসে আমি অন্তত ৩০-৪০ বার গিয়েছি। কাজ হয়নি। ইউএনও আবুল হায়াত স্যার সুপারিশ করার কারণে তিনি আমাদের কাজ করেননি’।
এ বিষয়ে সাবরেজিস্ট্রারদের পক্ষ থেকে বলা হয়, অভিযোগটি একেবারে অসত্য। পেনশনের জন্য আবেদন করা হয় গত ২৩ মে। ডাকযোগে পাঠানো আবেদনটি শিবগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিসে পৌঁছায় ২৫ মে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী আবেদনপত্রের সাথে প্রয়োজনীয় অনেক কাগজপত্র ছিল না।
এদিকে সাবরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীর স্ত্রী অরিনা বরকত যুগান্তরকে বলেন, হামলায় আহত হয়ে তার স্বামী অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। তিনি কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই। ঘুসের অভিযোগের বিষয়ে অরিনা বলেন, ‘তার স্বামী সৎ কর্মকর্তা। ইউএনওর নির্দেশেই হামলা হয়েছে। এখন ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে এসব বলে বেড়ানো হচ্ছে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা রেজিস্ট্রার আফসানা খাতুন বলেন, ‘আমরা সরকারি চাকরি করি, সবাই খুশি না, এটা সত্য। কিন্তু ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে কখনো কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। একটা অভিযোগও আসেনি।’ জেলা রেজিস্ট্রার দাবি করেন, ‘পেনশনের ফাইলপত্রকে কেন্দ্র করেই ইউসুফ আলীর ওপরে হামলার ঘটনা ঘটেছে।’