Logo
Logo
×

শেষ পাতা

শেষ দিনে বেচাকেনা বাড়বে

বিশ্ব ইজতেমা ঘিরে জমজমাট অর্থনীতি

অবকাঠামো, পরিবহণসহ কয়েকটি খাতে প্রভাব * অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জিডিপিতে প্রভাব ফেলবে

Icon

মনির হোসেন ও আলমগীর হোসেন, টঙ্গী থেকে ফিরে

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ব ইজতেমা ঘিরে জমজমাট অর্থনীতি

শুধু ধর্মীয় সমাবেশ নয়, বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জমজমাট হয়ে উঠেছে। মূলত এ অর্থনীতির আকার কত, তার সুনির্দিষ্ট কোনো গবেষণা নেই। তবে অর্থনীতির কয়েকটি খাতে এর প্রভাব পড়ছে।

এরমধ্যে রয়েছে-ইজতেমার জন্য অস্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ, প্রায় ২০ লাখ মানুষের ৩ দিনে ৭ বেলা খাবার, পানীয়, পরিবহণ ও জ্বালানির জন্য ব্যয়, বিভিন্ন পণ্যের বাণিজ্য এবং বিদেশি মেহমানদের কারণে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবেশ।

সরেজমিন দেখা গেছে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হলেও বিশাল সংখ্যক মানুষের কাছে ইজতেমা তিন দিনের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। কাঁচাবাজার, মাছ, মাংস, মুদি আইটেম, পোশাক, শীতের সামগ্রী, টুপি, জায়নামাজ, প্রসাধনী এবং বিলাসী সামগ্রীসহ এমন কোনো পণ্য নেই, যা এখানে মিলছে না। ১৬০ একর আয়তনের মাঠের চারদিকেই হাজার হাজার অস্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ দোকান। রয়েছে কিছু স্থায়ী দোকান ও বেশ কয়েকটি মার্কেট। কিছু দোকানের সামনে ক্রেতাদের ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে।

অন্যদিকে ইজতেমাকে কেন্দ্র করেই নির্দিষ্ট কিছু শিল্প গড়ে উঠেছে। আজ আখেরি মোনাজাতের দিন বেচাকেনা আরও বাড়বে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ধরনের আয়োজন দেশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সমৃদ্ধ করছে। মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি) অবদান রাখবে।

জানতে চাইলে ইসলামিক ইকোনমিকস রিসার্স ব্যুরোর সেক্রেটারি ও ইসলামী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ব ইজতেমার কারণে কয়েকভাবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অবকাঠামো, খাবার, পোশাক, অন্যান্য কেনাকাটা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবহণ এবং নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্য কিছু মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে মানুষ আসছে। বাস, লঞ্চ, ট্রেনে এবং কেউ কেউ বিমানে আসছেন। এতে পরিবহণ খাত লাভবান হচ্ছে। এছাড়া খাবার, পানীয়, আবাসন এবং কেনাকাটায়ও তারা অর্থ ব্যয় করছেন।

তিনি আরও বলেন, ইজতেমার কারণে প্রচুর সংখ্যক বিদেশি মেহমান বাংলাদেশে আসছেন। তারা ডলার নিয়ে আসছেন। এর ফলে আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। দিনশেষে যা রিজার্ভে যোগ হচ্ছে। তার মতে, ডলার সংকটের সময়ে এটি বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ। 

ইজতেমার আয়োজনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ ঘটে। ১৬০ একরের উন্মুক্ত মাঠে বাঁশের খুঁটির ওপর চট লাগিয়ে ছাউনি দিয়ে ইজতেমার জন্য প্রস্তুত করা হয়। এখানে প্রয়োজন হচ্ছে লাখ লাখ বাঁশ এবং চট। প্রচুর চট কেনাবেচা হয়।

আবার বিদেশি মেহমানদের জন্য টিনের ছাউনি ও বেড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ ও টেলিফোন লাইন এবং সমাবেশস্থলটি প্রথমে খিত্তা ও পরে খুঁটি নম্বর দিয়ে ভাগ করা হয়।

তিন শতাধিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা, পানির জন্য ১২ কিলোমিটার পাইপ লাইন, সাড়ে ৮ হাজার অস্থায়ী টয়লেট বসানো হয়েছে। পরিচ্ছন্নতার জন্য ব্লিচিং পাউডার সরবরাহ করা হচ্ছে।

মশা নিধনের জন্য ২৫টি ফগার মেশিন কাজ করছে। মাঠে প্রবেশের জন্য চারপাশে মোট ১৭টি প্রবেশপথ রয়েছে। সবগুলো পথ কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য জমজমাট হয়ে উঠছে। মূলমঞ্চের বাইরে মাঠে তৈরি করা হয়েছে কমপক্ষে ২ শতাধিক মোকাব্বির মঞ্চ।

নামাজের সময় ওইসব মঞ্চ থেকে ইমামের সঙ্গে আল্লাহ আকবর বলবেন, বাকিরা তা শুনে বলবেন। বয়ান শোনার জন্য ১২ হাজার মাইকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর সবকিছুর সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জড়িত। 

ইজতেমাকে কেন্দ্র করে কিশোরগঞ্জ থেকে এসেছেন পোশাক ব্যবসায়ী হেমায়েত উদ্দিন। ছেলেকে নিয়ে তিনি রাস্তার পাশে ছোট দোকান পরিচালনা করছেন। বিক্রি করছেন জামা ও মোটা কাপড়ের পায়জামা।

প্রতিটি জামার দাম ২৫০ টাকা। আর পায়জামা বিক্রি করছেন ৩০০ টাকা করে। তিনি জানান, শনিবার বেলা ৩টা পর্যন্ত ৩৫টি বেশির পণ্য বিক্রি করেছেন। আশা করছেন, যেসব পণ্য নিয়ে এসেছেন, সবই বিক্রি হবে।

শীতের চাদর বিক্রি করছেন গাজীপুর থেকে আসা ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান। তার দোকানে ২০০ থেকে ৮০০ টাকার চাদর রয়েছে। বেচাকেনা মোটামুটি। তবে তিনি বলছেন, শীত একটু বেশি থাকলে বেচাকেনা ভালো হতো।

২০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত জায়নামাজ বিক্রি করছেন গাজীপুরের আরেক ব্যবসায়ী ওলিউর রহমান। তিনি বলেন, ইজতেমাকে কেন্দ্র করেই এগুলো তৈরি। প্রতি পিসে লাভ করেন ৫ থেকে ৫০ টাকা।

টঙ্গীর চৌরাস্তায় মশারি বিক্রি করছেন আবুল হাশেম। বিভিন্ন দামের মশারি রয়েছে তার কাছে। ১৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয় এসব। তিনি বলেন, শুধু ইজতেমায় ব্যবহার নয়, মানুষ এসব কিনে দেশেও নিয়ে যাচ্ছে।

টঙ্গীর হোসেন মার্কেট থেকে ব্যাগ নিয়ে এসেছেন রুবেল আহমেদ। বিক্রি করছেন চামড়ার ব্যাগ। প্রতিটি ব্যাগের দাম ১৫০ থেকে ৪০০ টাকা। ইজতেমার বয়ান শুনতে পটুয়াখালী থেকে এসেছেন আবদুল আলিম ও নাসির উদ্দিন।

৭ নম্বর গেটের পাশে তাঁবুতে রয়েছেন তারা। আবদুল আলিম যুগান্তরকে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের কেনাকাটা তিনি, এখান থেকেই করছেন। কিনেছেন শীতের পোশাকও। 

ইজতেমা উপলক্ষ্যে বাংলাদেশে আগত বিদেশি মেহমানদের অনেকেই দেশে এক চিল্লা (তাবলিগ জামাতের ভাষায় ৪০ দিনে চিল্লা) থেকে তিন চিল্লার জন্য আসেন। ফলে তারা দীর্ঘ একটা সময় এ দেশে থাকেন।

এ সময়ে তারা অনেক কিছুই কেনাকাটা করেন। দেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিভিন্ন দেশের ২৫ হাজারের বেশি বিদেশি মেহমান ইজতেমায় অংশ নেন। বিদেশ থেকে চার ধরনের মেহমান আসেন।

ভারত ও পাকিস্তান থেকে আসেন কেন্দ্রীয় মুরুব্বি উলামায়ে কেরামরা। দ্বিতীয়ত দ্বীনের দাওয়াতে থাকা পুরাতন সাথীরা, তৃতীয়ত বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তি, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশের শরিয়া বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সব শেষে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বয়ান শুনতে ইজতেমার উদ্দেশ্যে দেশে আসেন।

যে সব দেশ থেকে মেহমানরা এসেছেন, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-মরক্কো, ফ্রান্স, মোজাম্বিক, রাশিয়া, জর্দান, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তিউনিশিয়া, যুক্তরাজ্য, ইউক্রেন, আমেরিকা, ফিলিস্তিনি, শ্রীলংকা, মিসর, সিরিয়া, বেলজিয়াম, সেনেগাল, জাম্বিয়া, কাতার, মালে, লেবানন, কিরগিজস্তান, নেপাল, ইয়েমেন, কেনিয়া, সুইডিস, ইথিওপিয়া, তুর্কি, মিয়ানমার, ক্যামেরুন ও আইভেরিকোস্ট। এসব মেহমানদের জন্য আলাদা ক্যাম্প রয়েছে। আর এই ক্যাম্পের আশপাশেই তাদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটার জন্য রয়েছে অস্থায়ী দোকান।

এসব দোকানে বেডিং, মশারি, কম্বল, জুতা, খাবার আইটেম, কাঁচাবাজার পানীয়সহ সব ধরনের ফলমূল পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রা পরিবর্তনের জন্য রয়েছে মানি চেঞ্জার। তবে ওমিক্রন বি-৭ এর কারণে বিদেশি মেহমানের সংখ্যা এবার তুলনামূলকভাবে কম। 

বিশ্ব ইজতেমার অর্থনীতি নিয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও লেখক ড. মো. মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, লোক সংখ্যার বিবেচনায় এটি বিশ্বের দ্বিতীয় মুসলিম সমাবেশ। এখানে বিপুলসংখ্যক মানুষের সম্মিলন ঘটে।

ফলে এই আয়োজনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব রয়েছে। তিনি বলেন, মাঠ ব্যবস্থাপনা, প্যান্ডেল তৈরি, বিভিন্ন দোকান, বিদেশি মেহমানদের আগমন এগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জড়িত।

এখানে বিপুল অঙ্কের বাণিজ্যক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এর সঙ্গে কর্মসংস্থানের বিষয় জড়িত। এতে দেশের জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি হয়। অন্যদিকে ইজতেমাকে ঘিরে অনেক পেশাজীবী মানুষ এক জায়গায় একত্রিত হন।

এতে লেনদেন ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম বেড়ে যায়। যা বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তিনি বলেন, দেশীয় পরিবহণের পাশাপাশি এয়ারলাইন্সগুলোও (উড়োজাহাজ কোম্পানি) লাভবান হচ্ছে।

রিজার্ভে বৈদেশিক মুদ্রা যোগ হচ্ছে। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। তার মতে, এই সমাবেশের কারণেই এমন অনেক পণ্য তৈরি হয়, যেটা অন্য সময় হয় না। এতে করে একটা শ্রেণির উপার্জনের পথ তৈরি হয়, যার মাধ্যমে ক্ষুদ্র শ্রেণির এই মানুষেরা লাভবান হন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম