সারা দেশে বিচারাধীন ৪২ লাখ
জটে আটকা চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার
সুপ্রিমকোর্টে বিচারাধীন সাত খুন, রাকিব-রাজন হত্যা, নুসরাত-রিফাত হত্যা, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ, পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ হত্যা, পিলখানা হত্যা মামলা
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
আলমগীর হোসেন
প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![জটে আটকা চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2023/01/05/image-631696-1672867174.jpg)
নারায়ণগঞ্জ থেকে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল অপহরণ হন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজন।
এ ঘটনার তিন দিন পর তাদের মৃতদেহ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। আলোচিত এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় প্রায় তিন বছর পর ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি বিচারিক আদালত রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, র্যাবের ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।
এরপর উচ্চ আদালত ২০১৮ সালের ২২ আগস্ট ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখে অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন।
নিম্ন ও উচ্চ আদালতের পর সাড়ে চার বছর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে মামলাটি শুনানির অপেক্ষায় আটকে আছে। শুধু এ মামলা নয়-এমন শতাধিক চাঞ্চল্যকর মামলা সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগে শুনানির জন্য অপেক্ষায় পড়ে আছে। প্রধান বিচারপতির পক্ষ থেকে মামলা নিষ্পত্তিতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কাজে আসছে না। প্রয়োজনের তুলনায় বিচারক, অবকাঠামো সংকটসহ নানা কারণে মামলাজটনামক অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলছে না বিচার বিভাগের।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায়ের রিভিউ, পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ হত্যা, পিলখানা হত্যা, শিশু রাজিব ও রাকিব হত্যা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল, পার্বত্য শান্তিচুক্তির কয়েকটি ধারা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে করা আপিল ও মেয়ের হাতে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলা।
আর উচ্চ আদালতে (হাইকোর্টে) নুসরাত জাহান রাফি হত্যা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, হোলি আর্টিজান হামলা মামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ খান হত্যা ও রমনা বটমূলে বোমা হামলাসহ বেশকিছু মামলা ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় অপেক্ষায় থাকা নিহতের আত্মীয়স্বজন হতাশ হয়ে পড়েছেন। বিচার নিয়ে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এসব চাঞ্চল্যকর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, এত বিপুলসংখ্যক চাঞ্চল্যকর মামলা আটকে থাকাটা উদ্বেগজনক। বিচারক ও বেঞ্চ বাড়িয়ে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
আসামিপক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ এসএম শাহজাহান যুগান্তরকে বলেন, হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সগুলো বছর অনুযায়ী সিরিয়ালি শুনানি হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি হয়ে থাকে। বর্তমানে বিপুলসংখ্যক ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি বলেন, অনেক সময় নির্দোষ ব্যক্তির বিচারিক আদালতে সাজা হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা বছরের পর বছর কনডেম সেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে। এজন্য ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের আপিল শুনানি করে দ্রুত নিষ্পত্তি করা দরকার। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর এসব মামলা বিচারিক আদালত শেষে এখন সুপ্রিমকোর্টে বিচারাধীন। এসব মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছেন বিচারপ্রার্থীরা। দ্রুত এসব মামলা শুনানির উদ্যোগ নেওয়া দরকার। রাষ্ট্রপক্ষকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, বেশকিছু পুরোনো মামলা ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য মামলার শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। দুদকের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি অপেক্ষমাণ। এসব মামলা শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ থেকে উদ্যোগ না নেওয়া হলে দুদকের পক্ষ থেকে নেওয়া হবে। সুপ্রিমকোর্টের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। এটা সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার। তবে কিছু মামলা শুনানি হচ্ছে বলে তিনি জানান।
এদিকে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী সততা ও দক্ষতা নিয়ে ন্যায়বিচার করার মানসে মনোনিবেশ করার জন্য জেলা ও দায়রা জজদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। গত ২৭ ডিসেম্বর সুপ্রিমকোর্ট মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। পাশাপাশি সততা ও দক্ষতা নিয়ে ন্যায়বিচার করার মানসে মনোনিবেশ করার জন্য দেশের সব বিচারককে দিকনির্দেশনা দেন। এছাড়া প্রধান বিচারপতি দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি কীভাবে করা যায়, এ বিষয়ে বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেন। বিচারপ্রার্থী মানুষকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দ্রুত বাড়ি ফেরানোর জন্য সবাইকে যথাযথভাবে বিচারকাজ পরিচালনা করার নির্দেশনা দেন তিনি।
রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক ইচ্ছা মামলাজট কমিয়ে আনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে বলেছিলেন, বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। আমরা এমন অবস্থা চাই না। মানুষ যেন ন্যায্য বিচার পায় এবং ন্যায্য বিচার যেন অতি দ্রুত পায়, সেই ব্যবস্থা চাই।
সুপ্রিমকোর্ট সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪১ লাখ ৯৮ হাজার ৫৫৩টি। এর মধ্যে আপিল বিভাগে ১৭ হাজার ৫৪৭ এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ১৮ হাজার মামলা বিচারাধীন। আপিল বিভাগের বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে ১১ হাজার ৯৭৮টি দেওয়ানি, ৫ হাজার ৪৫৪টি ফৌজদারি এবং ১১৫টি আদালত অবমাননার অভিযোগে করা মামলা। অন্যদিকে হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে ৮৯ হাজার ২০৭টি দেওয়ানি, ৩ লাখ ১২ হাজার ৬৫৯টি ফৌজদারি এবং রিট ও আদিম দেওয়ানি মিলিয়ে আরও ১ লাখ ১৬ হাজার ১৩৫টি মামলা বিচারাধীন। অন্যদিকে ৬৪ জেলার অধস্তন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ৩৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫টি মামলা।
একাধিক আইনজীবী জানান, সাধারণত বছর ও মামলার ক্রম অনুসারে ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) শুনানি হয়ে থাকে। তবে গুরুত্ব বিবেচনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতেও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হয়ে থাকে। ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনানির জন্য হাইকোর্টে কয়েকটি বেঞ্চ রয়েছে। আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতে আট শতাধিক ডেথ রেফারেন্স মামলা এখন বিচারাধীন। ২০১৬ সালে আসা ডেথ রেফারেন্সের শুনানি এখন শেষ পর্যায়ে।
বরগুনার রিফাত হত্যার ডেথ রেফারেন্স : বরগুনা জেলা শহরে ২০১৯ সালের ২৬ জুন ভরদুপুরে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রিফাতকে। বিচারিক আদালতের রায়ে রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়, বাকি চার আসামি বেকসুর খালাস পান। রায়ের পর নিয়ম অনুযায়ী মিন্নিসহ ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য নথি আসে হাইকোর্টে। এরপর একই বছর মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেন মিন্নি। সে সময় হাইকোর্ট তার আপিল গ্রহণ করে বিচারিক আদালতের রায়ে ৫০ হাজার টাকার অর্থদণ্ড আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করে। পরে বিভিন্ন গ্রাউন্ডে হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মিন্নি।
মিন্নির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে কাশিমপুর কারাগারের কনডেম সেলে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন মিন্নি। অসুস্থতাসহ বিভিন্ন গ্রাউন্ডে আমরা তার জামিন চেয়েছি। আবেদন হাইকোর্টে শুনানির জন্য রয়েছে।