ব্যান্ডউইথের মূল্যে বৈষম্য
আইএসপিগুলোর দাবি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’
বৈষম্যের শিকার হচ্ছে দেশীয় আইএসপিগুলো - ইমদাদুল হক সভাপতি, আইএসপিএবি * নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপ বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সিদ্ধান্তকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে-সাহেদ আলম, চিফ করপোরেট ও রেগুলেটরি অফিসার, রবি আজিয়াটা * অনিয়ম রোধে কিছু ট্যারিফ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ট্যারিফ নির্ধারণের দরকার নেই; বাজার নিজেই সুষম মূল্য নির্ধারণে সক্ষম হবে -মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী, চেয়ারম্যান, বিটিআরসি
মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের (এমএনও) আধিপত্যের ফলে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে দেশীয় ইন্টারনেট সেবাদাতা (আইএসপি) প্রতিষ্ঠানগুলো। আইআইজি প্রতিষ্ঠান থেকে এমএনওরা তুলনামূলক কম দামে ব্যান্ডউইথ কিনলেও সাধারণ ব্যবহারকারীরা মোবাইল ইন্টারনেট কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। অন্যদিকে, উচ্চ মূল্যে ব্যান্ডউইথ কিনে আইএসপিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা বাজারে প্রতিযোগিতার ভারসাম্য নষ্ট করছে। এ ব্যবস্থার ফলে রাজস্ব হারাচ্ছে বিটিআরসি এবং ন্যায্যমূল্যে সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন গ্রাহক।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশের এমএনও প্রতিষ্ঠানগুলো ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতা আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় প্রায় অর্ধেক মূল্যে ব্যান্ডউইথ ক্রয় করে। কিন্তু সেই সুবিধা গ্রাহকদের ওপর পড়ছে না; বরং ব্রডব্যান্ডের তুলনায় মোবাইল ইন্টারনেটের দাম এখনো বেশি। এমন অসম দাম ইন্টারনেট সঞ্চালনব্যবস্থায় বৈষম্য তৈরি করছে বলে মনে করে আইএসপিগুলো।
বিটিআরসি ২০২১ সালে আইএসপিগুলোর জন্য ব্যান্ডউইথের ট্যারিফ নির্ধারণ করে, যা ২০২৬ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। ঢাকার মধ্যে প্রতি এমবিপিএস ব্যান্ডউইথের সর্বনিম্ন মূল্য ৩৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৯৯ টাকা নির্ধারিত। অথচ এমএনওদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট ট্যারিফ নেই। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশের বৃহৎ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন প্রতি এমবিপিএস ব্যান্ডউইথ ২১৮ টাকায় কিনছে, যেখানে আইএসপিগুলোর জন্য তা ৩৬৫ টাকা। একাধিক আইআইজি প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুসারে, মোবাইল অপারেটরদের কাছে ব্যান্ডউইথের বিক্রয়মূল্য গড়ে ১৮০ টাকা, যা আইএসপিগুলোর তুলনায় অর্ধেক।
এ ব্যাপারে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের (আইএসপিএবি) সভাপতি ইমদাদুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘মোবাইল অপারেটররা কম মূল্যে ব্যান্ডউইথ কিনলেও গ্রাহকদের জন্য ইন্টারনেটের মূল্য কমায়নি। বরং মোবাইল ইন্টারনেটের দাম ব্রডব্যান্ডের তুলনায় বেশি। এতে ভোক্তারা সুবিধা পাচ্ছে না, অন্যদিকে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে দেশীয় আইএসপিগুলো।’
তিনি বলেন, আমরা চাই ইন্টারনেট সঞ্চালন ব্যবস্থায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হোক। ব্যান্ডউইথের একক মূল্য নির্ধারণ করা হলে বা ন্যূনতম দাম কমিয়ে ১৮০ টাকায় আনা হলে ইন্টারনেট খরচ কমবে এবং গ্রাহকরা উপকৃত হবেন। অন্যথায়, বর্তমান বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় দেশীয় আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে এবং সাধারণ গ্রাহকরাও সাশ্রয়ী ইন্টারনেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।
এছাড়া সরকার ইন্টারনেটের দাম ২০ শতাংশ কমানোর কথা বলছে। আমি বলতে চাই, আইএসপি পর্যায়ে সেবার সুফল পেতে হলে আইআইজি এবং এনটিটিএন পর্যায়ে দাম কমাতে হবে। অন্যথায় এর সুফল মিলবে না বলেও যোগ করেন ইমদাদ।
এদিকে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের মূল্য নির্ধারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপ চায় না মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটররা। রবি আজিয়াটার চিফ করপোরেট ও রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম জানান, ব্যান্ডউইথের মূল্য ভলিউম, মান ও দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল এবং এটি পুরোপুরি বিজনেস-টু-বিজনেস (B2B) প্রক্রিয়া। উৎপাদন ব্যয়, মূল্যনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যেখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপ বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সিদ্ধান্তকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তিনি মনে করেন, বাজার স্বাভাবিক নিয়মেই পরিচালিত হওয়া উচিত, যাতে মোবাইল প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন ও বিনিয়োগ প্রবাহ নির্বিঘ্ন থাকে। অতএব, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারণকেই মোবাইল অপারেটররা যৌক্তিক মনে করেন। আইআইজি থেকে কম দামে ক্রয় করেও গ্রাহক পর্যায়ে স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট সেবা দিতে পারছেন না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে সাহেদ আলম বলেন, ব্যান্ডউইথের খরচ ইন্টারনেটের মূল্যনির্ধারণে মোট পরিচালন ব্যয়ের মাত্র ২.৫ শতাংশ, যেখানে তরঙ্গের মূল্য, ট্রান্সমিশন, টাওয়ার ব্যবস্থাপনার মতো অপারেশনাল খরচ বড় ভূমিকা রাখে; পাশাপাশি সরকারি কর, নিয়ন্ত্রক সংস্থার রাজস্ব এবং সর্বোপরি পরিচালন ব্যয়ের ওপরই ইন্টারনেটের মূল্য নির্ধারণে মূল ভূমিকা রাখে।
আরেকটি অপারেটর বাংলালিংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা ই-মেইলের মাধ্যমে প্রশ্ন পাঠানোর কথা বললেও পরে আরও উত্তর দেননি।
অন্যদিকে টেলিকম খাতে ট্যারিফ ব্যবস্থা শিথিলের পক্ষে বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী যুগান্তরকে বলেন, কিছু ক্ষেত্রে বাজারের নিজস্ব প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ইন্টারনেটের মূল্যনির্ধারণের পক্ষে তারা। তবে অনিয়ম রোধে কিছু ট্যারিফ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। তার মতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ট্যারিফ নির্ধারণের দরকার নেই; কারণ বাজার নিজেই সুষম মূল্যনির্ধারণে সক্ষম। ট্যারিফব্যবস্থা শিথিল হলে গ্রাহকরা প্রতিযোগিতামূলক মূল্য সুবিধা পাবেন। তিনি বলেন, আমরা এমনভাবে রিফর্মগুলো করছি, যেন ট্যারিফের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন না পড়ে।
আইএসপি অপারেটররা বলছেন, তারা বৈষম্যের শিকার, এমন প্রশ্নে জনাব এমদাদুল বারী বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত তাদের সঙ্গে কথা বলছি। যদি তারা এমন দাবি করে থাকে, তাহলে সেটা দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।