
প্রিন্ট: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৩০ এএম
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলারস-এর (আইইউএমএস) ফতোয়া
ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ ফরজ

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
গাজায় মুসলিম ভাইদের বিরুদ্ধে চলমান নৃশংস আগ্রাসন অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছি আমরা। শহিদের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। দখলদার ইহুদিবাদী রাষ্ট্র যথারীতি যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। তারা আবারও একের পর এক নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করেছে। যার প্রতি মার্কিন সরকারের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তারা ইসরাইলি আগ্রাসনকে ক্রমাগত ধ্বংসাত্মক বোমা ও অস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে। অন্যদিকে আরব দেশগুলো নীরব। মুসলিম বিশ্ব নিষ্ক্রিয়। ফতোয়া কমিটি ইসলামি শরিয়ার বিধান ব্যাখ্যা করে আলেমদের ওপর আল্লাহর আরোপিত দায়িত্ব পালন করছে। এ বিষয়ে আমাদের নির্দেশনা হলো-
জিহাদের আবশ্যকতা
ইহুদিবাদী দখলদার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জিহাদ করা বাধ্যতামূলক। যে কেউ গাজায় আমাদের ভাইদের হত্যায় অংশগ্রহণ করবে, সে যে কোনো দেশের সৈন্য হোক বা ভাড়াটে, তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া, মুজাহিদদের সামরিক সরঞ্জাম, সামরিক দক্ষতা ও গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করা অপরিহার্য। এটি প্রথমে ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর, তারপর প্রতিবেশী দেশগুলোতে (মিশর, জর্দান, লেবানন) এবং তারপর সব আরব ও মুসলিম দেশে প্রয়োগ করতে হবে। ফিলিস্তিনে দখলদারত্বের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ইসলামি বিশ্বের প্রতিটি সক্ষম মুসলমানের জন্য ফরজ। ইউনিয়নের ইজতিহাদ ও ফতোয়া কমিটি নিশ্চিত করছে, আমাদের দেশগুলোর সরকারের ধর্মীয় দায়িত্ব হলো, তাদের আদেশ অনুসারে এ গণহত্যা ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধের জন্য অবিলম্বে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পদক্ষেপ নেওয়া। গাজার এহেন পরিস্থিতিতে আরব ও মুসলিম সরকারের সমর্থন আবশ্যক। নির্যাতিত ভাইদের পাশে না দাঁড়ানো মানবতাবিরোধী অপরাধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের কী হলো, তোমরা আল্লাহর পথে ও নির্যাতিত পুরুষ, নারী ও শিশুদের পক্ষে লড়াই করছ না?’ (সূরা নিসা, আয়াত : ৭৫)। এ ব্যর্থতা রাষ্ট্রের আস্থার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবে বিবেচিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা জেনেশুনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে খেয়ানত করো না। তোমাদের আমানতের সঙ্গেও খেয়ানত করো না।’ (সূরা আনফাল, আয়াত : ২৭)।
শত্রুকে সহায়তা করা নিষিদ্ধ
গাজায় মুসলমানদের গণহত্যায় দখলদার শত্রুকে যে কোনো ধরনের সহায়তা নিষিদ্ধ। তা অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে হোক বা তাদের অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহের মাধ্যমে হোক। একইভাবে দখলদার রাষ্ট্রকে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহায়তা (যার মধ্যে তেল, গ্যাস ও মৌলিক খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ অন্তর্ভুক্ত) নিষিদ্ধ।
মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যের প্রয়োজন
কমিটি মুসলিম বিশ্ব, তাদের ধর্ম, রক্ত, সম্পদ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অবিলম্বে একটি ঐক্যবদ্ধ সামরিক জোট প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামি ও আরব দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। এটি না করলে বিরাট বিপর্যয় ঘটবে। যে কেউ কাফের ইহুদিবাদী শত্রুর প্রতি ভালোবাসা ও ইসলামি প্রতিরোধকে ধ্বংস করার আকাঙ্ক্ষা থেকে এটি করে, সে মুরতাদ। তার ওপর ইসলামের অভিভাবকত্ব বাতিল করা হবে। যদি সে লাভের লোভ বা অনুরূপ কিছুর কারণে করে, তাহলে সবচেয়ে বড় পাপ ও গুরুতর সীমালঙ্ঘন করবে। এ কাজগুলো ইসলামি আইনে নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা প্রকৃতপক্ষে একে অপরের মিত্র। তোমাদের মধ্যে যে কেউ তাদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করবে, সে অবশ্যই তাদেরই একজন। নিশ্চয় আল্লাহ জালেমদের পথ দেখান না।’ (সূরা মায়িদা, আয়াত : ৫১)।
চুক্তির পুনর্মূল্যায়ন দরকার
দখলদার রাষ্ট্রের সঙ্গে যেসব ইসলামি দেশ চুক্তি করেছে, সেগুলো পুনর্বিবেচনা করা উচিত। কারণ, চুক্তির উদ্দেশ্য হলো ইসলামি স্বার্থ। অতএব, দখলদার রাষ্ট্রের চুক্তি লঙ্ঘন ও অব্যাহত লঙ্ঘনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা দরকার। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের সাধ্যমতো শক্তি ও অশ্বারোহী বাহিনী প্রস্তুত রাখ। যাতে তারা আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদের ভীত করে তোলে।’ (সূরা আনফাল, আয়াত : ৬০)। আজকের বিশ্ব রাজনীতিতে দুর্বল, বিভক্ত ও খণ্ডিতদের স্থান নেই। প্রতিরোধ ও সুরক্ষার জন্য আরব ও ইসলামি দেশগুলোর একটি ঐক্যবদ্ধ সামরিক জোটই মুসলিম ও এ অঞ্চলের জন্য নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা অর্জন করবে। একটি বৈশ্বিক ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি গঠন করবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা কুফরি করে, তারা একে অপরের বন্ধু। যদি তোমরা তা না কর, তাহলে পৃথিবীতে বিপর্যয় দেখা দেবে। বড় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।’ (সূরা আনফাল, আয়াত : ৭৩)।
দখলদার বাহিনীর সঙ্গে চুক্তির পর্যালোচনা
কমিটি দখলদার বাহিনীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ইসলামি দেশগুলোর পর্যালোচনা এবং সে অনুযায়ী শত্রুর ওপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছে। যেহেতু চুক্তিগুলো মুসলিম জনস্বার্থ অর্জনের লক্ষ্যে তৈরি, তাই এ বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের জন্য সেগুলো পর্যালোচনা করা ও কী কারণে এগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, দখলদার শত্রু কী প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে এবং কী লঙ্ঘন করেছে, তা মূল্যায়ন করার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
আর্থিক জিহাদের বাধ্যবাধকতা
আর্থিক জিহাদ করা সামর্থ্যবান প্রত্যেকের ওপর ফরজ। মুসলমানদের উচিত, জাকাত দেওয়ার পাশাপাশি মুজাহিদদের সহায়তা করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা স্বল্প বা প্রচুর সরঞ্জামের সঙ্গে বেরিয়ে পড়। নিজেদের মাল ও জান দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ কর। এটি তোমাদের জন্য অতি উত্তম, যদি তোমরা বুঝতে পার।’ (সূরা তাওবা, আয়াত : ৪১)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একজন যোদ্ধাকে প্রস্তুত করল, সে প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ করল। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একজন যোদ্ধার পরিবারের দেখাশোনা করল, সে প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ করল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৩০৬)। আমাদের অবশ্যই সম্ভাব্য সব উপায়ে মুজাহিদদের কাছে অর্থ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। মুজাহিদদের পরিবারের যত্ন নেওয়া, তাদের জীবিকা নির্বাহ করা এবং জিহাদ ও প্রতিরোধের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা আমাদের কর্তব্য।
জনসচেতনতায় আলেমদের তৎপরতা
বিশ্বের ওলামায়ে কেরাম শরয়ি নির্দেশনা পালনে জোর দিন। আত্মতুষ্টিতে ভুগবেন না। অবশ্যই সত্যের পক্ষে কথা বলুন। সম্ভাব্য সব উপায়ে দখলদার শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদের বাধ্যবাধকতা ঘোষণা করুন। মুসলিম দেশগুলোর শাসকগোষ্ঠী, সরকারি সেনাবাহিনী ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কর্তব্য পালন এবং ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও সভ্যতার দায়িত্ব পালনের তাগিদ দিন।
মুসলিম শাসক ও জনগণের প্রতি আহ্বান
ইহুদিবাদী শক্তি ও যারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, তাদের বয়কট করুন। রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাহার করে রাজনৈতিক বয়কট করুন। তাদের কাছ থেকে অস্ত্র, সরঞ্জাম, বিমান, গাড়ি ও অন্যান্য পণ্য কেনা থেকে বিরত থেকে অর্থনৈতিক বয়কট করুন। সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও অন্যান্য বয়কটও করুন। বসতি নির্মাণ কোম্পানির অংশীদার দেশগুলোর জন্য সেখানে থাকাও নিষিদ্ধ করুন।
মার্কিনিদের কাছে আবেদন
যারা গাজায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য ট্রাম্পের প্রচারণা ও মুসলিম ভোটারদের প্রতি তার সমর্থন গ্রহণ করেছে, তাদের এ প্রতিশ্রুতিগুলো মনে করিয়ে দিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম সম্প্রদায়গুলোকে ট্রাম্প ও মার্কিন সরকারের ওপর সব বিষয়ে চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানান।
ইহুদি ও তার সহযোগীদের বয়কট
দখলদার ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে যে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। যেসব মুসলিম দেশ এদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে, অবিলম্বে তাদের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফেরদের প্রতি তাদের আনুগত্য ও সহায়তা নিষিদ্ধ করতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনি তাদের অনেককে দেখতে পাবেন, যারা কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে। তাদের প্রবৃত্তি তাদের জন্য যা এগিয়ে দিয়েছে, তা মন্দ। আল্লাহ তাদের ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন। তারা চিরকাল শাস্তিতে থাকবে। যদি তারা আল্লাহ, রাসূল ও তাঁর প্রতি অবতীর্ণ বিষয়ের ওপর ইমান আনত, তাহলে তাদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করত না। কিন্তু তাদের অনেকেই পাপী।’ (সূরা মায়িদা, আয়াত : ৮০-৮১)।
মুসলিম জনগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য
গাজার ভাইদের চিকিৎসা সহায়তা, খাদ্য, পোশাক বা জ্বালানি, যা-ই হোক না কেন, সম্ভাব্য সব সহায়তা দেওয়া মুসলমানদের কর্তব্য। যদি কোনো মুসলিম দেশ এগুলো নিষিদ্ধ করে, তাহলে আল্লাহর জন্য এ আইনগুলো উপেক্ষা করা জনগণের উচিত। কারণ, নির্যাতিতদের সাহায্য করা শাসকের আনুগত্যের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।
বিভেদ ভুলে বিশ্ব মুসলিমের একতা
এ কঠিন সময়ে মুসলমানদের সব ধরনের বিরোধ ভুলে ধর্মীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়া আবশ্যক। সব ফিলিস্তিনি উপদলের ক্ষেত্রে এর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। সেইসঙ্গে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আরব ও ইসলামি ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার ওপর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কারণ, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করো না; তাহলে দুর্বল হয়ে পড়বে, তোমাদের শক্তি কমে যাবে।’ (সূরা আনফাল, আয়াত : ৪৬)।
দোয়া ও কুনুতে নাজেলার আমল
ফরজ ও নফল নামাজে কুনুতে নাজেলা পড়া চাই। সর্বদা ফিলিস্তিনি মুসলমানদের জন্য রোনাজারি করা জরুরি। কারণ, দোয়াই সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র।