
প্রিন্ট: ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ১০:২৪ পিএম
মানসিক প্রশান্তি মিলে স্রষ্টার প্রতি ভরসায়

অধ্যক্ষ ডা. মিজানুর রহমান
প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
মূলত এ পৃথিবীতে মানুষকে প্রেরণ করা হয়েছে সফলতা অর্জনের জন্য। সফল হওয়ার জন্য আজীবন সামর্থ্যানুযায়ী চেষ্টা-সাধনা করেও খুব কমসংখ্যক মানুষই সফলতা লাভ করেন। মানুষের প্রচলিত জীবন সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নায় ভরপুর। এক্ষেত্রে জীবনযুদ্ধে ইসলামে হতাশার কোনো সুযোগ বা অধ্যায় নেই। মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, হে ইমানদারগণ ‘আল্লাহর রহমত থেকে কখনো নিরাশ হয়ো না’। মূলত মানবতা আর মানবাধিকার যেখানে প্রতিষ্ঠিত থাকে, সেখানে স্বভাবতই বৈষম্য আর শোষণের মাত্রা কমে গিয়ে জননিরাপত্তা ও শান্তি বিরাজ করে, ইসলাম সব সময় এমন পরিবেশ আশা করে।
এক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তা মানবজাতির কিসে কল্যাণ আর কিসে অকল্যাণ সে ক্ষেত্রে যুগেযুগে পথ প্রদর্শক বা বার্তাবাহক নিয়োগ করেছেন। যারা প্রদর্শকের কথা ও আদর্শ বুকে ধারণ করে জীবনকে আল্লাহর রঙে রঙিন করতে চেষ্টা-সাধনা করতে পারেন, তারাই মূলত সফলকাম। আর যারা প্রদর্শকের আদেশ, নিষেধ ও উপদেশ উপেক্ষা করে জীবনযাপন করেন, তারা সাময়িক বৈষয়িক সফলতা অর্জন করলেও নিজ নিজ বিবেকের কাছে অপরাধী হয়েই মৃত্যুবরণ করবেন এবং পরকালে সুনিশ্চিতভাবে তিরস্কৃত হবেন, এটা মহাগ্রন্থ আল কুরআনের পুর্বাভাষ।
প্রতিবছর ৭ এপ্রিল ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস’, ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ ও ১০ অক্টোবর ‘বিশ্ব মানসিক দিবস’ যথাযথ মর্যাদায় উদযাপনে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু এর আশানুরূপ কোনো ফল পাওয়া যায় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক সংজ্ঞানুযায়ী স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য ও ধর্মীয় স্বাস্থ্যকে বুঝানো হচ্ছে। মন ও শরীর একে অপরের পরিপূরক, সুতরাং শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিভাবে সুস্থ থাকার নামই স্বাস্থ্য বলে অভিহিত করা হচ্ছে। মূলত মানব সত্তা মানসিক, আবেগ ও ভৌতিক স্তরে বিভক্ত, আর জীবনী শক্তি হলো এগুলোর পরিচালক রুহ বা প্রাণশক্তি হলো আল্লাহর হুকুম।
জীবনী শক্তিকে যেমন রোগশক্তি আক্রমণ করে তেমনি বিবেক শক্তিকে আবেগ শক্তি সার্বক্ষণিকভাবে আক্রমণ করে। এতে রোগশক্তি শক্তিশালী হলে জীবনী শক্তি পরাজিত হয়, আর আবেগের শক্তি শক্তিশালী হলে বিবেকের শক্তি পরাজয় বরণ করে থাকে। এ জয়-পরাজয়ের খেলার ফলাফলের ওপর একটি রাষ্ট্রের উত্থান-পতন নির্ভর করে। এভাবে একটি দেশের মানুষ যত পরিমাণ ক্ষতিকর আবেগতাড়িত হয় সে দেশের অসভ্যতার মাত্রাও তত পরিমাণ বেড়ে যায়। আর আবেগের একমাত্র নিয়ন্ত্রক হলো ধর্মবিশ্বাস বা তাকওয়া। এ তাকওয়া বা স্রষ্টাভীতি বিনা ব্যয়ে সব মানুষের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় জাদু-মন্ত্রের মতো নীরবে কাজ করে। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার প্রয়োজন পড়ে না, শুধু জুমাবারের উপযুক্ত মূল্যবান খুতবাই যথেষ্ট। কারণ মসজিদ ও অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো মানবাত্মার হাসপাতাল। সুতরাং বলা যায়, মসজিদ মানবসভ্যতা ও মানবিক মূল্যবোধ বিকশিত করার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু। যেখানে মানসিক উৎকর্ষ সাধনের প্রশিক্ষণ চলছে যুগ থেকে যুগান্তর। যেখানে খতিব সাহেব প্রভাষক মিম্বরে দাঁড়িয়ে প্রতি সপ্তাহে হতাশাগ্রস্ত মানুষের মনের চিকিৎসার জন্য নতুন ব্যবস্থাপত্র প্রদান করে থাকেন।
আমেরিকার বিখ্যাত দার্শনিক উইলিয়াম জেমস বলেছেন, নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তার সবচেয়ে বড় চিকিৎসা হচ্ছে ধর্মবিশ্বাস। মানসিক রোগ দূরীকরণে ধর্মচর্চার কোনো বিকল্প নেই। মানসিক প্রশান্তির জন্য ধর্মীয় রীতিনীতির অনুশীলন খুবই প্রয়োজন। শুধু ধনসম্পদ ও সামাজিক মর্যাদা মানুষের আত্মার প্রশান্তি, সুন্দর জীবন ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে না। বরং এগুলো ক্রমান্বয়ে মানুষকে বিলাসী করে তোলে। অপরদিকে ধর্মচর্চা মানুষকে অন্যায়-অবিচার করার প্রবণতা কমিয়ে আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করে সমাজে সভ্যতাকে করে বিকশিত এবং মানবিক মূল্যবোধ জাগরিত করে। নফসের উন্মাদনা, রিপুর নিয়ন্ত্রণে ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলার অভ্যাস যত বেশি বাড়বে সমাজে প্রচলিত অনাচার, অবিচার ততবেশি দূর হয়ে আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের পথ সুগম হবে।
মূলত মানুষের জীবনটা অনেকটা দাবা খেলার মতো, খেলার সময় কাঠের কিংবা প্লাস্টিকের ঘুঁটিগুলো একই উপাদানে তৈরি হলেও এক একটা ঘুঁটির নাম ভিন্ন ভিন্ন। মান-মর্যাদার দিক থেকেও আলাদা আলাদা। কোনোটা সাধারণ সৈনিক, কোনোটা হাতি, কোনোটা রাজা, কোনোটা সেনাপতি, কোনোটা প্রজা। খেলা শেষ হলে খেলোয়াড় সব ঘুঁটি একই কৌটায় ভরে রাখে। দুনিয়ার মানুষগুলো একই উপাদান মাটি থেকে সৃষ্টি, দুনিয়ার খেলার মাঠে এক একজন এক এক পরিচয়ে, স্ব স্ব স্থানে নানা পদমর্যদায়, নানা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং চলমান। একপর্যায়ে খেল খতম হলে সবাইকে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে হয়।
মহান আল্লাহতায়ালাও এ ক্ষেত্রে বলেছেন, ‘দুনিয়ার জীবনটা খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়’। খেলায় হারজিত একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ খেলায় সফলতার মাত্রার চেয়ে বিফলতার মাত্রাই বেশি। সেক্ষেত্রে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করবে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট’। ‘তোমরা হতাশ হয়ো না, ভয় পেয়ো না তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হও’ এই অমীয় বাণী হতাশাগ্রস্ত জ্ঞানী মানুষের জন্য সুধাসুরের মতো কাজ করে। সাহস ও চেতনা বাড়ায়।
এ ক্ষেত্রে স্ব স্ব ধর্মের মৌলনীতি জানা ও মানার প্রবণতা বৃদ্ধি করতে হবে। বিশেষ করে ওহির বিধান আল কুরআনের ভাষা, ভাব, আদেশ, নিষেধ ও উপদেশগুলো জানা বোঝা এবং তদনুযায়ী জীবনযাপনের চেষ্টা যত বেশি বাড়বে সমাজে বা রাষ্ট্রে এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অরাজকতা ততই রোধ করা সম্ভব হবে। এজন্য আত্মসমালোচনার অভ্যাসের মাধ্যমে স্ব স্ব মস্তিষ্কের ডোমাপিন ও সেরোটোনিন নামক রাসায়নিক উপাদান নিঃসৃত করতে হবে। সেইসঙ্গে শাসক-শোষক উভয় শ্রেণির মানুষের আবেগের লাগাম টেনে ধরার মোহিনী শক্তি স্রষ্টার প্রতি ভরসার পরিমাণ বাড়াতে হবে। কারণ, একজন শান্তিকামী মানুষের যাবতীয় বিপদ-মুসিবতে মানসিক প্রশান্তি বাড়ায়-রবের প্রতি অকৃত্রিম ভরসায়।
সাময়িক পৃথিবীর মায়া, অসম বৈভবের প্রতিযোগিতা, ক্ষমতার মোহ, আত্মার প্রতি অমিতাচার কমিয়ে আমাদের সত্যিকারের মানবিক গুণাবলির অধিকারী হয়ে অমরত্ব লাভের সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে হবে। সর্বোপরি সৃষ্টিকর্তার এক একজন প্রতিনিধি হিসাবে রবের ওপর অকৃত্রিম ভরসা এবং স্রষ্টা কর্তৃক আমাদের ওপর তার অর্পিত হুকুম-আহকাম, দায়-দায়িত্ব যথাযথভাবে প্রতিপালনের চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই মানসিক অবসাদমুক্ত নির্মল জীবন গঠন করে দুনিয়াতে শান্তি ও আখিরাতে মুক্তির ক্ষেত্রে দীপ্ত ইমানের সাহস বাড়বে, যে সাহস একজন মুত্তাকি তাকওয়ার বলে বলিয়ান হয়ে অতি সহজেই জান্নাতের অধিকারী হয়ে মহান আল্লাহর দিদার লাভের সৌভাগ্য অর্জন করবে। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে এমন প্রকৃতির জীবন গঠনের তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : জাতীয় প্রাবন্ধিক গবেষক দার্শনিক ও সাংবাদিক
mizanurrahmand470@gmail.com