
প্রিন্ট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৪২ এএম
দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাতের ভূমিকা

ইবরাহীম আল খলীল
প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
জাকাত ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। ইমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হলো নামাজ ও জাকাত। কুরআনে কারিমের বহু স্থানে জাকাতের আদেশ করা হয়েছে। তার গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা এবং এর সুফল ও উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য তাতে অশেষ সওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি সম্পদের পবিত্রতা এবং আত্মশুদ্ধিও রয়েছে।
আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, তোমরা নামাজ আদায় কর এবং জাকাত প্রদান কর। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর কাছে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখছেন। (সূরা বাকারা, আয়াত : ১১০)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, তোমরা নামাজ আদায় কর, জাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার। (সূরা নূর, আয়াত : ৫৬)। কুরআনে কারিমের বিভিন্ন আয়াতে, যেখানে খাঁটি মুমিনের গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে সেখানে নামাজ ও জাকাতের কথা এসেছে অপরিহার্যভাবে। এত অধিক গুরুত্বের সঙ্গে নামাজ ও জাকাতের প্রসঙ্গ কুরআনে কারিমে এসেছে যে, এটা ছাড়া দ্বীন ও ইমানের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। যারা জাকাত ফরজ হওয়া সত্ত্বেও আদায় করে না তাদের যে মর্মন্তুদ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে তা-ও কুরআনে কারিমে বলে দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদের দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে তারা যেন কিছুতেই মনে না করে যে, এটা তাদের জন্য মঙ্গল। না, এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যে সম্পদে তারা কৃপণতা করেছে কিয়ামতের দিন তা-ই তাদের গলায় বেড়ি হবে। আসমান ও জমিনের স্বত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবগত। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৮০)।
ইসলাম সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। ধনী-গরিবের দূরত্বকে কমানোর জন্য এবং সঙ্গে সঙ্গে বিত্তশালীদের মালের পবিত্রতার জন্য ইসলাম নিয়ে এসেছে জাকাতের বিধান। জাকাতদাতা গরিব ব্যক্তিকে জাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো জাগতিক স্বার্থ রাখতে পারবে না। জাকাত আদায়কালে আদায়কারীর উদ্দেশ্য হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি। এর বিপরীত যে কোনো প্রয়াসে জাকাত আদায় হবে না। জাকাত আদায়কারী ব্যক্তি গরিবকে জাকাত দান করে তার ওপর কোনো অনুগ্রহ করছেন এমন ভাবলেও তা অন্যায় বলে বিবেচিত হবে। কারণ সম্পদের ওই নির্দিষ্ট অংশ হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া গরিবের হক। তা গরিবের অধিকার। ধনীরা জাকাত আদায় করা মানে নিজেদের দায়িত্ব আদায় করা। গরিবের ওপর অনুগ্রহ করা নয়। কেননা কুরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে এবং তাদের (ধনীদের) সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার। (সূরা জারিয়াত, আয়াত : ১৯)। সুতরাং আপনি এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন যে, আপনি দরিদ্রদের সাহায্য করছেন বরং আপনি জাকাত আদায়ের মাধ্যমে আপনার সম্পদের হক আদায় করছেন।
ইসলাম ধনীদের সম্পত্তির বর্ধিত অংশকে গরিবের পাওনা বা হক হিসাবে দেখে। যে কারণে জাকাত গরিব, মিসকিন ও বঞ্চিতদের হক। সেটি আপনি আমি কখনোই আত্মসাৎ করতে পারি না। আমাকে আপনাকে আল্লাহ সম্পদশালী করেছেন তার মানে এ নয় যে, সে সম্পদে কারও হক নেই। বরং ইসলামি বিধিবিধান অনুসারে ধনীদের ৪০ ভাগের ১ ভাগ সম্পদ গরিব ও অসহায় মানুষের মাঝে বিতরণ করার নির্দেশনা রয়েছে। জাকাত সম্পদের শতকরা আড়াই শতাংশ হিসাবে আল্লাহর নির্ধারিত খাতে এটি বণ্টন করতে হয়। অথচ আমরা গরিব-মিসকিন ও অসহায় মানুষদের দান করতে অনেক সময় কার্পণ্য করি। মনে রাখবেন জাকাত আদায় করার মাধ্যমে সম্পদ কমে না বরং আরও বাড়ে। তাতে বরকত হয়। জাকাত আদায়ের মাধ্যমে মুসলমানদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। ভাব-মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকে এবং আত্মমর্যাদা ও সম্মানবোধ বৃদ্ধি পায়।
যারা জাকাত প্রদান করে তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ, আর যারা জাকাত দিতে কার্পণ্য করে তাদের জন্য রয়েছে দুঃসংবাদ। এ বিষয়ে এক হাদিসে মহানবি (সা.) ইরশাদ করেছেন, কোনো বান্দা যখন জাকাত আদায় করেন, তখন আল্লাহর আদেশে একজন ফেরেশতা তার জন্য এভাবে দুয়া করতে থাকেন, হে আল্লাহ আপনার পথে যে দান-সদকা করে এবং জাকাত দেয়, তার সম্পদকে আপনি বৃদ্ধি করে দিন। আর যে ব্যক্তি সম্পদ ধরে রাখে (জাকাত দেয় না) তার সম্পদ আপনি ছিনিয়ে নেন। (সহিহ বুখারি)।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে মানুষ আজ জাকাতের উদ্দেশ্যকে না বুঝার কারণে জাকাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত নিয়ে তামাশা করছে। একদিকে ইসলামি খেলাফত ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই জাকাত আদায় করছে না, আর যারাও করছে তারাও সঠিকভাবে সম্পদের হিসাব-নিকাশ না করেই কিছু শাড়ি-লুঙ্গি দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব থেকে মুক্ত মনে করছে। জাকাতের উদ্দেশ্য কিছু শাড়ি-লুঙ্গি আর টাকা বিলানোর নাম নয়; বরং জাকাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে জাকাত পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিকে কর্মসংস্থান (যেমন : গরু কিনে দেওয়া, দোকান দিয়ে দেওয়া, রিকশা কিনে দেওয়া ইত্যাদি) সৃষ্টি করে দেওয়া, যাতে এ বছর যাকে জাকাত দেওয়া হচ্ছে পরবর্তী সময়ে তাকে আর জাকাত দেওয়া না লাগে।
খুলাফায়ে রাশেদীন ও তার পরবর্তী সময়ে সঠিকভাবে জাকাত আদায়ের ফলে মুসলিম বিশ্বে জাকাত নেওয়ার মতো লোক পাওয়া বেশ দুরূহ হয়ে পড়েছিল। এটা হলো জাকাতের সুফল, যা সমাজে শান্তি নিয়ে আসে আর দারিদ্র্যবিমোচন করে কর্ম সংস্থানের সৃষ্টি করে।
আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে নিজেদের সম্পদের হক আদায় করে দরিদ্রদের মাঝে জাকাত বিতরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক, মাদ্রাসা আশরাফুর মাদারিস, তেজগাঁও ঢাকা