Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

আল-কুরআন আলোকিত জীবনের দিশা

Icon

শাইখ মুহাম্মাদ জামাল উদ্দীন

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আল-কুরআন আলোকিত জীবনের দিশা

জ্ঞানগর্ভ ও উপদেশে ভরা কুরআন জীবনের জন্য অপরিহার্য একটি গাইড বই। মানুষ কোথায়, কখন কী করবে, কেন করবে, কীভাবে করবে সব বিস্তারিত বলে দেওয়া হয়েছে কুরআনে। কুরআন তথা আল্লাহ প্রদত্ত আসমানি কিতাবের হেদায়াতের বাইরে কোনো জীবনদর্শন নেই, কোনো ধর্মদর্শন নেই, কোনো মুক্তির পথ নেই।

মানব জাতির সূচনালগ্নেই এ কথাটি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাবা আদম ও মা হাওয়া (আ.)কে আল্লাহ যখন পৃথিবীতে বিচরণের জন্য পাঠিয়েছেন, তখন আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন-‘আমি তাদের বলেছিলাম, তোমরা সবাই এখান থেকে দুনিয়ায় যাও। তারপর তোমাদের মঙ্গলের জন্য আমি অবশ্যই যুগে যুগে সত্যপথের দিকনির্দেশনা প্রেরণ করব। তখন যারা এ দিকনির্দেশনা অর্থাৎ কিতাবের বিধিবিধান অনুসরণ করবে, তাদের কোনো ভয় বা দুঃখ থাকবে না।

আর যারা এ কিতাবের নৈতিক বিধিবিধান অস্বীকার করবে, তারাই জাহান্নামের আগুনে পুড়বে। সেখানেই থাকবে তারা চিরকাল।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ৩৮-৩৯।)

তার মানে দুনিয়ার জীবনে শান্তি আর আখেরাতের জীবনে মুক্তি জন্য আল্লাহর কাছ থেকে যুগে যুগে হেদায়াত এসেছে। সে হেদায়াত যারা মেনে চলবে তাদের কোনো ভয় নেই আর যারা অস্বীকার করবে তাদের কোনো রক্ষা নেই। উম্মতের মুহাম্মাদির জন্য সর্বশেষ আসমানি হেদায়াতের নাম আল কুরআন। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জীবনে ন্যায়-ইনসাফ-শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কুরআনের বিকল্প নেই। একইভাবে আখেরাতের মুক্তির জন্য মানুষের জন্য কুরআন এক অপরিহার্য গ্রন্থ’।

আল্লাহ বলেন, ‘হে নবি! এ কুরআন অনুসরণ যিনি তোমার ওপর ফরজ করেছেন, তিনি অবশ্যই তোমাকে চূড়ান্ত গন্তব্যে ফিরিয়ে আনবেন। যারা সত্য অস্বীকার করছে তাদের বল, ‘আমার প্রতিপালক খুব ভালো করে জানেন, কে সত্যধর্ম নিয়ে এসেছে আর কে সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে লিপ্ত।’ (সূরা কাসাস, আয়াত ৮৫)।

কুরআন অনুসরণ শুধু আল্লাহ ফরজই করেননি বরং এ ফরজকে কতটুকু আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করেছে সেটাও কিয়ামতের দিন আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন। এরপরই ফায়সালা হবে তার জন্য জান্নাত না জাহান্নাম অপেক্ষা করছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমার ওপর যে ওহি নাজিল হয়েছে, তা অনুসরণে অটল থাক। তুমি সাফল্যের সরলপথেই আছ। নিঃসন্দেহে এ কুরআন তোমার ও তোমার অনুসারীদের জন্য অত্যন্ত সম্মানের বিষয়। কিন্তু সময় হলে তোমাদের অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এ কুরআন নিয়ে তোমরা কী করেছ?’ (সূরা জুখরুফ, আয়াত ৪৩-৪৪)।

‘তুমি তাদের মতোই আল্লাহর রাসূল, যাদের ওপর আমি কিতাব নাজিল করেছিলাম। কিন্তু পরে তাদের অনুসারীরা একে টুকরো টুকরো করেছে এবং ওরাই এখন এ কুরআনকে মিথ্যা বলছে! কিন্তু তোমার প্রতিপালকের শপথ! মহাবিচার দিবসে আমি ওদের সবাইকে এ কুরআন সম্পর্কে জবাবদিহি করব।’ (সূরা হিজর, আয়াত ৯০-৯৩।)

মানুষ অজ্ঞ। সে নিজের পরিচয়ই জানে না। মানুষ অন্ধ, সে নিজের স্রষ্টাকেই চেনে না। কুরআন মানুষের চোখ খুলে দেয়। তাকে জানিয়ে দেয় তার পরিচয়। জানিয়ে দেয় প্রভুর পরিচয়। তার গলায় পরিয়ে দেয় ইমানের মালা। যুগে যুগে রাসূলদের দাওয়াতি মিশন ছিল এটাই। আল্লাহকে চেনানো। কুরআনে আল্লাহ বলেন-রাসূলরা বলল, ‘আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্বের বিষয়ে কি কোনো সন্দেহ থাকতে পারে? যিনি মহাকাশ ও পৃথিবীর সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা? তিনি তোমাদের ডাকছেন, যাতে তিনি তোমাদের অতীতের সব পাপ মোচন করতে পারেন এবং নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ভালো কাজ করার সুযোগ দিতে পারেন।’ (সূরা ইবরাহিম, আয়াত ১০।)

কুরআনের দাওয়াত খুব জটিল কোনো বিষয় নয়। বরং মানুষ যেন মানুষ হতে পারে, তার জীবনে যেন কোনো বিকৃতি না আসে অথবা যে বিকৃতি এসেছে সেটা যেন সংশোধন হয়ে যায়, এটাই কুরআনের উদ্দেশ্য। ফলে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের জন্যও কুরআন অপরিহার্য। আল্লাহ বলেন, ‘আসলে বিবেক প্রয়োগ করে সত্য না জানার কারণে সীমালঙ্ঘনকারীরা নিজেদের কামনা-বাসনার অনুসরণ করে। এ কারণে আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট হতে দেন, কে তাকে সৎপথ দেখাবে? ওরা কারও সাহায্যও পাবে না। অতএব, হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা সকল মিথ্যা পরিত্যাগ করে একনিষ্ঠভাবে ধর্মের ওপর নিজেদের কায়েম রাখ। আল্লাহ যে প্রকৃতিতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, সে সৎ প্রকৃতির অনুসরণ কর। আল্লাহর সৃষ্ট এ প্রকৃতিকে দূষিত-বিকৃত কর না। এটাই সত্যধর্ম-সর্বোচ্চ ধর্মবিধান। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না।’ (সূরা রুম, আয়াত ২৯-৩০)।

কুরআনের প্রথম আয়াত নাজিল হয় ৬১০ সালে আর শেষ আয়াত ৬৩২ সালে। ধাপে ধাপে খণ্ডে খণ্ডে দীর্ঘ ২৩ বছরে পূর্ণতা পায় কুরআন। প্রথম আয়াত নাজিল হওয়ার পরই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এর আকর্ষণী ক্ষমতা। অবিদ্যা বা জাহেলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষগুলো, আলোর সন্ধান পায়। সে আলোয় বদলাতে শুরু করে তারা। পিতৃপুরুষের হাজার বছরের সংস্কার ও ধর্মান্ধতার বৃত্ত ভেঙে তারা লাভ করে মুক্ত বিশ্বাস ও সঠিক জীবনদৃষ্টি। এরপর নিজের মুক্তির জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য কোনো ত্যাগ স্বীকারেই পিছপা হয়নি তারা। অবিদ্যা, হিংসা, সন্ত্রাস, রক্তপাত, শোষণ, জুলুম আর নারী নির্যাতনে নিমজ্জিত মানুষই পরিণত হয় সত্য ও ন্যায়ের মূর্ত প্রতীকে।

দলীয়, গোত্রীয় ও উপজাতীয় হানাহানিতে লিপ্ত বিক্ষিপ্ত সম্প্রদায়গুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরিণত হয় এক, দুর্দমনীয় আদর্শিক জাতিসত্তায়। এটাই ছিল নবির মিশন। কুরআনের ভিশন। আল্লাহ বলেন, শেষ বাণীবাহক নিরক্ষর রাসূলের বিবরণ তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ রাসূল মানুষকে ভালো কাজের নির্দেশ দেবে এবং খারাপ কাজ করতে নিষেধ করবে, জীবনের ভালো জিনিসগুলো হালাল করে দেবে এবং যা জীবনের জন্য ক্ষতিকর তাকে হারাম করে দেবে। সে অতীতের সব শৃঙ্খল ও বোঝা থেকে তাদের মুক্ত করবে। অতএব, যারা তাকে বিশ্বাস করবে, সম্মান করবে, সহযোগিতা করবে এবং তার ওপর নাজিল হওয়া আলোর অনুসরণ করবে, তারাই সফলকাম হবে।’ (সূরা আরাফ, আয়াত, ১৫৭।)

কুরআন কেবল ব্যক্তি জীবনকেই পরিশুদ্ধ করে না বরং জাতিকেও বিশ্বের দুয়ারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে ভূমিকা রাখে। কুরআনের প্রথম আয়াত নাজিল হওয়ার ৫০ বছরের মধ্যে মুসলমানরা সে সময়ের পরাশক্তি রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যকে নিশ্চিহ্ন করে পরিণত হয় তখনকার একমাত্র পরাশক্তিতে। ‘আলিফ-লাম-মীম। রোমানরা নিকটবর্তী অঞ্চলে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু এ পরাজয় সত্ত্বেও কয়েক বছরের মধ্যে ওরা বিজয়ী হবে। আগের ও পরের সব ফয়সালার এখতিয়ার শুধু আল্লাহর।

একদিন আল্লাহর দেওয়া বিজয়ে বিশ্বাসীরা আনন্দিত হবে। তিনি যাকে ইচ্ছা বিজয় দান করেন। তিনি মহাপরাক্রমশালী, পরমদয়ালু। আল্লাহ বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আল্লাহ কখনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা বোঝে না। ওরা পার্থিব জীবনের দৃশ্যমান বিষয়েই শুধু জানে। কিন্তু চূড়ান্ত নিগূঢ় সত্য সম্পর্কে ওদের কোনো জ্ঞানই নেই। (সূরা রুম, আয়াত ১-৭।)

ইতিহাস সাক্ষী! কুরআন ছাড়া আর কোনো গ্রন্থই প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের হৃদয়ে এত আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি, এত দ্রুত মানুষকে এমনভাবে বদলে দিতে পারেনি। কুরআন সরাসরি যাদের সামনে নাজিল হয়েছিল, তারাই শুধু আলোকিত হননি; ধর্মান্ধতা ও পাশবিকতার পরিবর্তে ধর্ম, মানবিকতা ও মুক্তবুদ্ধির এ স্রোত প্রবাহিত হয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্মে, শতাব্দীর পর শতাব্দী। ধর্ম, মানবিকতা ও মুক্তবুদ্ধির এ স্রোত ইতিহাসের মধ্যযুগে সৃষ্টি করেছিল এক আলোকোজ্জ্বল সভ্যতা। কুরআনের অনুসারীরা যখন শিল্পসাহিত্য, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় অবগাহন করছিল তখন ইউরোপ ডুবে ছিল অজ্ঞতা ও ধর্মান্ধতার অন্ধকার যুগে। প্রাচ্যের এ আলোকোজ্জ্বল সভ্যতা থেকেই ইউরোপের দেশে দেশে কুরআনের মানবিকতা ও মুক্তবুদ্ধির বাণী পৌঁছাতে থাকে বিভিন্নভাবে। ই

উরোপে সূচনা হয় রেনেসাঁ বা মুক্তবুদ্ধির জাগরণ। নতুনভাবে শুরু হয় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা। এগোতে থাকে বিজ্ঞান। তাই নিঃসংশয়ে বলা যায়, কুরআন যে মানবিকতা, জ্ঞানচর্চা ও মুক্তবুদ্ধির শিক্ষা দিয়েছে তারই ফল্গুধারায় লালিত হয়ে বিশ্ব প্রবেশ করেছে বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে। তাই অকপটে বলা যায় জীবন-সভ্যতা ও প্রযুক্তির উৎতর্ষতায় কুরআনের ভূমিকা অপরিসীম।

লেখক : চেয়ারম্যান, জামালী তালিমুল কুরআন ফাউন্ডেশন এবং খতিব, রূপায়ণ টাউন সেন্ট্রাল মসজিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম