Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ইমানি দায়িত্ব

Icon

আবদুর রাকীব মাসুম

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ইমানি দায়িত্ব

কুরআন-হাদিস ও মনীষীদের বক্তব্যে অন্যায়ের প্রতিরোধের ব্যাপারে কার্যকর দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, মানুষের কল্যাণে তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় কাজে বাধা প্রদান করবে।’ (সূরা আলে ইমরান : ১১০)।

অন্যত্র তিনি এরশাদ করেন, ‘আর ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দকে প্রতিহত কর তা দ্বারা, যা উৎকৃষ্টতর। তাহলে তোমার ও যার মধ্যে শত্রুতা রয়েছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো।’ (সূরা ফুসসিলাত : ৩৪)।

নিজে অন্যায় কাজ করা যেমন বারণ অন্যকে পাপ কাজে সহযোগিতা করাও বারণ। আল্লাহ এরশাদ করেন-‘সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা করো। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ আজাব প্রদানে কঠোর।’ (সূরা মায়িদা : ২)।

সহিহ্ মুসলিমের একটি হাদিসের শেষাংশে এসেছে, ‘আর যে ব্যক্তি কোনো পথভ্রষ্টতার প্রতি আহ্বান করবে, তার ওপর তাদের অনুরূপ পাপ বর্তাবে, যারা তার অনুসরণ করবে। তবে সে তাদের (অনুসারীদের) পাপকে লঘু করবে না।’ (হাদিস নং-২৬৭৪)।

যদি অন্যায়ের যথাযথ প্রতিবাদ না করা হয়, সময়মতো প্রতিরোধ না করা যায়, এর পরিণতি ভোগ করতে হয় গোটা জাতিকে। পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা পাওয়া যায়, যেখানে অন্যায় ও অবাধ্যতায় লিপ্ত লোকদের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, যারা নিজেরা সৎ ছিল কিন্তু লোকদের খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করত না। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তারা পরস্পরকে মন্দ থেকে নিষেধ করত না, যে মন্দ তারা করত। তারা যা করত, তা কতই না নিকৃষ্ট!’ (সূরা মায়িদাহ : ৭৯)।

হজরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.)কে বলতে শুনেছি, ‘যদি মানুষ কোনো মন্দ কাজ দেখে এবং তা প্রতিরোধ না করে, তবে আল্লাহ শিগ্গির তাদের সবাইকে শাস্তির সম্মুখীন করবেন।’ (তিরমিজি : ২১৬৮)।

অন্য হাদিসে নবিজি (সা.) এরশাদ করেন, ‘সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! নিশ্চয়ই তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করবে। নতুবা আল্লাহতায়ালা শিগ্গির তোমাদের ওপর তাঁর শাস্তি অবতীর্ণ করবেন। তখন তোমরা তাঁর কাছে দোয়া করলেও তিনি তোমাদের সেই দোয়া কবুল করবেন না।’ (জামে তিরমিজি : ২১৬৯)।

অন্যায়ের প্রতিবাদ করা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বোত্তম জিহাদ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘স্বৈরাচারী শাসকের সামনে ন্যায়সংগত কথা বলা উত্তম জিহাদ।’ (সুনানে আবু দাউদ ৪৩৪৪)।

তবে এক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে, প্রতিবাদ করতে গিয়ে যেন ফ্যাসাদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়ে যায়। এক অন্যায় দমন করতে গিয়ে যেন আরেক অন্যায়ের পথ খুলে না যায়। এ ব্যাপারেও ইসলাম সুন্দর নির্দেশনা দিয়েছে। অন্যায়ের প্রতিবাদের স্তরবিন্যাস করে দিয়েছে।

হাদিসে পাকে এরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কোনো অন্যায় হতে দেখলে সে হাত দিয়ে (শক্তি প্রয়োগ করে) তা প্রতিহত করবে। যদি তা না পার তবে কথা দিয়ে প্রতিহত করবে, তাও না পারলে অন্তর দিয়ে (ঘৃণা করবে)। এটিই ইমানের দুর্বলতম স্তর।’ (সহিহ মুসলিম : ৭৪)। অর্থাৎ প্রত্যেকেই নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করবে। এটাই ইসলামের শিক্ষা। সামর্থ্যরে বাইরে করতে গেলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ কোনো ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যরে বাইরে দায়িত্ব দেন না।’ (সূরা বাকারাহ : ২৮৬)।

মনীষীদের বক্তব্যেও এর গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। বিখ্যাত দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন, ‘সমাজে অন্যায় তখনই বিস্তার লাভ করে যখন সৎ লোকেরা নীরব থাকে।’ ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ইসলামের একটি মৌলিক দায়িত্ব যা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত।’

মোট কথা, সুন্দর ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়তে হলে অন্যায় ও অপরাধকে দমন করার বিকল্প নেই। আজ সর্বত্র যে অশান্তি আর অরাজকতার জয়জয়কার, এর অন্যতম কারণ হলো অপরাধের অবাধ স্বাধীনতা। স্বার্থকেন্দ্রিক এ সমাজে প্রত্যেকেই আপন স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। সবাই নিজের ভালোকেই যথেষ্ট মনে করে। সমাজ বা রাষ্ট্রের ভালো নিয়ে কারও তেমন মাথাব্যথা নেই। অপরাধীদের কেউ প্রতিহত করে না। অন্যায় ও অপরাধকে ঘৃণার চোখে দেখে না।

সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। অপরাধীরা ধরা পড়লেও বিভিন্ন তদবির ও ঘুসের বলে পার পেয়ে যায়। যার ফলে তারা আরও বেশি অপরাধ করার সাহস পাচ্ছে। দিনদিন অন্যায়ের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জুলুম-অত্যাচার-গুম-খুন-ধর্ষণ-ব্যভিচার-সুদ-ঘুস-দুর্নীতি ইত্যাদি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। রাষ্ট্রের কর্ণধাররা পরিণত হচ্ছে জালিম স্বৈরশাসকে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হলো-সবাই মিলে অন্যায়ের প্রতিরোধ করা। ব্যক্তিগত সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় কোনো অন্যায়কেই বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় না দেওয়া। আর এজন্য প্রয়োজন ইসলামি বিধিনিষেধ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। এক্ষেত্রে যেমন ব্যক্তির ধর্মীয় জ্ঞান থাকতে হবে, তেমনি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবেও ধর্মীয় অনুশাসনের চর্চা ও প্রয়োগ করতে হবে। কারণ আল্লাহর ভয় না থাকলে কোনো আইন মানুষকে অন্যায় থেকে বিরত রাখতে পারে না। পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। অপরাধের যথাযথ শাস্তি প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কেউ যেন অপকর্ম করে পার পেয়ে না যায় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তবেই একটি সুখী ও সুন্দর সমাজ গঠন সম্ভব হবে। সমৃদ্ধ ও আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম