রজব মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত
কুলসুম রশীদ
প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পবিত্র কালামে পাকে সূরা তাওবার ৩৬ নম্বর আয়াতের ভাবার্থে দেখতে পাই, সৃষ্টির প্রথম দিনেই লওহে মাহফুজে আরবি বারো মাসের নাম লিপিবদ্ধ হয়েছিল। তবে মাসগুলোর ধারাবাহিকতা আসমান ও জমিন সৃষ্টির পর মুহূর্তে হয়েছে। তার মধ্যে রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মহররম-এ চারটি মাস বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন।
মুসলিম জাতির কাছে হারাম বলে চিহ্নিত এমন কোনো গর্হিত কাজ এ মাসগুলোতে করা যায় না। মাসগুলো খুব বরকতময়। এতে ইবাদতের সওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
প্রিয় রাসূল (সা.)-এর নবুয়তের মহাগুণাবলির অন্যতম উজ্জ্বল নিদর্শন হলো মেরাজের ঘটনা। পবিত্র মেরাজ শরিফের ঘটনা ঘটার আগে, রাসূল (সা.)-এর ওপর একের পর এক দুর্যোগ নেমে এসেছিল-স্নেহময় চাচা আবু তালেব ও প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রা.)-এর ইন্তেকাল এবং তায়েফবাসীদের অভাবনীয় অত্যাচার।
রজব মাসের ২৭ তারিখে রাসূল (সা.) হজরত উম্মে হানি (রা.)-এর গৃহে ঘুমিয়ে ছিলেন। আল্লাহ পাকের হুকুমে হজরত জিবরাইল (আ.) আগমন করে নিজ পালক খুব আদরের সঙ্গে রাসূলে পাক (সা.)-এর পবিত্র কদম মোবারকে বুলিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে ছিলেন মেরাজের রাতে।
মহান সত্তা আল্লাহতায়ালা, যিনি মুহাম্মাদ (সা.)কে মাসজিদুল হারাম (কাবা শরিফ) থেকে মাসজিদুল আকসা (বাইতুল মোকাদ্দাস) পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে তার আরশে মোয়াল্লা পর্যন্ত ভ্রমণ করান। এর মধ্যে তাকে অসংখ্য নিদর্শন দেখানো হয়।
এ সফরে ফেরেশতা হজরত জিবরাইল (আ.) একটা নির্দিষ্ট সীমা (সিদরাতুল মুনতাহা) পর্যন্ত তার সফরসঙ্গী ছিলেন। সেখান থেকে তিনি একাই রফরফ নামে একটি যানে করে আরশে আজিম অভিমুখে রওয়ানা দেন। সত্তর হাজার নুরের পর্দা ভেদ করে তিনি আরশে আজিমে পৌঁছান। সেখানে এক ধনুক দূরত্ব থেকে আল্লাহর সঙ্গে তার কথোপকথন হয়।
মহান পরওয়ারদিগারের সঙ্গে কথোপকথনের একপর্যায়ে আরজ করলেন যে, আজ তাকে ধরা দিয়েছেন এটাই কি তার উম্মতের জন্য যথেষ্ট হবে কিনা। উত্তরে আল্লাহ পাক জানালেন, প্রিয় হাবিবের উম্মতের জন্য প্রত্যহ পাঁচবার দর্শন দেবেন। আসসালাতু মিরাজুল মু’মিনিন। এর জন্য রজবের মাসকে অবহেলায় বিদায় করা উচিত হবে না।
এক নামাজের ভেতর অনেক রকম ইবাদত একত্রে হয়ে যায়। যেমন-আরশে মোয়াল্লায় কোনো কোনো ফেরেশতার দল একনাগাড়ে কিয়াম করে আছেন, কেউ রুকু, আবার কেউ সেজদায়। তাশাহহুদে মেরাজের রাতের আল্লাহ ও তার রাসূলের কথোপকথন। এছাড়া দরুদ, কুরআন তেলাওয়াত, সালাম, জিকির, তাসবিহ-তাহলিল ইত্যাদি। এ যেন একের মধ্যে বহুর সমাবেশ।
রজব শব্দটি আরবি তারজীব শব্দ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ সম্মান দেখানো। এ মাসে তওবাকারীদের প্রতি আল্লাহ পাকের বেশি পরিমাণে রহমত বর্ষিত হয়। তাছাড়া ইবাদতকারী লোকদের ওপর কবুলিয়াতের নূর নাজিল হয়। শুধু তা-ই নয়, এ মাসটিকে আল-আসামও বলা হয়। কেননা, এ মাসে যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ থাকার কারণে তা কখনো সংঘটিত হতো না। বেহেশতে রজব নামে একটি ঝরনা রয়েছে। তার পানি দুধ অপেক্ষাও সাদা, মধু থেকেও মিষ্টি এবং বরফ থেকেও শীতল। যে ব্যক্তি রজব মাসে রোজা রাখে শুধু সে ব্যক্তিই বেহেশতের এ পানি পান করবে।
হুজুরে পাক (সা.) বলেছেন, রজব হলো আল্লাহর মাস, শাবান হলো আমার মাস এবং রমজান হলো আমার উম্মতের মাস। তাই তিনি রজব মাসজুড়ে এ দোয়া বেশি পড়তেন ‘আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি রজাবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রমাদান,
অর্থ-হে আল্লাহ! আপনি রজব ও শাবান মাসকে আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং আমাদের রমজান মাস পর্যন্ত (হায়াত দিন) পৌঁছে দিন। রজবকে রজব বলার কারণ, আল্লাহ পাক এ মাসে বান্দাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন, সওয়াব দেন এবং এমন সব পুরস্কার ও মর্যাদায় ভূষিত করেন, যা মানুষ এর আগে দেখেওনি, শোনেওনি। রজব মাসে একজন রোজাদারও যদি আল্লাহর কাছে পরকালে প্রত্যাশী হয়, তবে সে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং বেহেশত পাবে।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হুজুরে পাক (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রজব মাসের ২৭ তারিখে রোজা রাখে তার আমলনামায় ষাট (৬০) মাসের রোজার সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হয়। রাসূল (সা.)-এর প্রতি সর্বপ্রথম ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) রজব মাসে নবুয়তের খবর নিয়ে এসেছিলেন। হজরত বড় পির আব্দুল কাদের জীলানী (রহ.) তার প্রণীত গুনিয়াতুত্ ত্বালিবীন পুস্তকে রজব মাসের একাধিক রোজা রাখার ফজিলত বর্ণনা করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ-যে রজব মাসে চারটি রোজা রাখবে সে পাগলামি, কুষ্ঠ, অন্ধত্ব এবং দাজ্জালের ফেতনা থেকে বেঁচে থাকবে। যে পাঁচ রোজা রাখবে, সে কবরের আজাব থেকে রক্ষা পাবে। তার কিতাবে আরও বলেছেন : হজরত ওকবা বিন সালাম বিন কায়স (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, যদি কেউ রজব মাসে সদকা করে, তবে আল্লাহ পাক তাকে দোজখ থেকে বহু দূরে রাখবেন। রজব মাসের প্রথম রাতটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাত জেগে ইবাদত বন্দেগিতে মত্ত থাকা দরকার।
হুজ্জাতুল ইসলাম হজরত ইমাম গাজ্জালী (রহ.) তাকে মুকাশাফাতুল ক্কুলুব গ্রন্থে লিখেছে, ইমাম দিলামী (রহ.) বর্ণনা করেছেন হুজুর পাক (সা.) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ পাক চারটি রাতে অধিক পরিমাণে রহমত নাজিল করেন। সেগুলোতে কেউ আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলে তা প্রত্যাখ্যাত হয় না। রাতগুলো হলো-
রজব মাসের প্রথম রাতসহ রজব মাসের যে কোনো রাত, শাবান মাসের পনেরো তারিখের রাত, দুই ঈদের রাত। মহান রাব্বুল আলামিনের রহমত, বরকত ও নাজাত পাওয়ার আশায় আমাদের মাস রমজানে পৌঁছানোর জন্য এ রজব মাসে বেশি বেশি রোজা, নামাজ, তওবা ও অন্যান্য বন্দেগির সঙ্গে দান-সদকা করে যাব।