মুসলিম শিশুর প্রথম পাঠ
তাহমিনা আক্তার
প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাচ্চাদের শৈশবকাল হলো স্বচ্ছ কাচের মতো, যা পরে প্রতিফলিত হয়। এ বয়সেই তার পরিচয় বিকশিত হয়। তাই মুসলিম শিশুর প্রথম শিক্ষা হওয়া উচিত ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তাওহিদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের পরিচয়। জন্মের পরপরই শিশুর ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত দেওয়ার মাধ্যমে এ শিক্ষা শুরু করতে হয়। কিন্তু শিশু বেড়ে উঠার পরবর্তী ধাপগুলোতে দ্বীন শিক্ষা নিয়ে আমরা গাফিলতি করি।
সন্তানকে কুরআন শেখায় না এমন মা-বাবার হার যদি শতকরা ৭০ হয়ে থাকে তবে দ্বীন শেখায় না এদের হার শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ। নামাজ কীভাবে পড়বে তাও শেখায় না। হালাল-হারাম, পাক-নাপাক, ওজু-গোসল তো দূরের কথা। অথচ সন্তানকে দ্বীনের প্রয়োজনীয় বিষয়াদি শেখানো পিতা-মাতার ওপর ফরজ। এটা না শেখানো সন্তানের ওপর সবচেয়ে বড় জুলুম।
শিশুকে দুনিয়াবি বিষয়াদি যতটা গুরুত্বের সঙ্গে শিক্ষা দেওয়া হয়, দ্বীনি শিক্ষার ক্ষেত্রে ততটুকু গুরুত্ব দেওয়া হয় না। শিশুকে জেনারেল লাইনে পড়াশোনা করালেও আগে দ্বীনের শিক্ষা দেওয়া উচিত।
একটা শিশু একটা চারাগাছের মতোই। যেনতেনভাবে একটা চারা রোপণ করলেই যেভাবে ভালো একটা গাছের আশা করা যায় না, ঠিক তেমনিভাবে আমরা আমাদের সন্তানকে দ্বীনের শিক্ষা না দিয়ে বড় হলে দ্বীনদার হয়ে যাবে এমন আশা করা যায় না। দ্বীনদার হওয়ার জন্য ছোট থেকেই তাদের দ্বীনের শিক্ষা দিয়ে বড় করতে হবে, ঠিক যেভাবে দুনিয়া শেখানোর জন্য ছোট থেকেই আমরা তাদের দুনিয়াবি শিক্ষা দিতে থাকি।
ছোটদের দ্বীন শিক্ষার বিষয়ে আমাদের গাফিলতির পেছনে অবশ্য একটা বড়োসড়ো কারণ আছে আর তা হলো দ্বীন বলতে কী বোঝায় সেটা সম্পর্কেই আমরা অজ্ঞ। আমরা মনে করি কায়দা, আমপারা হয়ে কুরআন পড়া, কিছু দোয়া শেখা আর নামাজ শেখা, এই হচ্ছে দ্বীন। দ্বীনকে আমরা প্রায়ই ধর্মকর্মের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। আমাদের বুঝতে হবে ধর্ম বলতে যা বোঝায়, দ্বীন বলতে তা বোঝায় না। দ্বীন হচ্ছে অনেক ব্যাপক একটা শব্দ, যার মধ্যে ধর্ম আছে। আমরা শিশুদের দ্বীন শিক্ষা দেব।
আমরা অবশ্যই তাদের কালিমা, নামাজ, কুরআন শেখাব তার পাশাপাশি তারা আল্লাহকে চিনবে, আল্লাহর রাসূলকে জানবে, সাহাবিদের জানবে। তারা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আল্লাহ প্রদত্ত আদেশ-নিষেধ জানবে ও মানবে। এভাবেই তাদের দ্বীনের ছাঁচে গড়ে তোলা হবে। এটাই হচ্ছে দ্বীন শিক্ষা।
সন্তানসন্ততি মহান আল্লাহতায়ালার দেওয়া অমূল্য সম্পদ। তাদের মাধ্যমেই আল্লাহতায়ালা বাবা-মাকে পরীক্ষা করবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন-‘আর জেনে রাখ! তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি অকল্যাণের সম্মুখীনকারী (মহাপরীক্ষা)। বস্তুত আল্লাহর কাছে রয়েছে মহাসওয়াব।’ (সূরা আনফাল : আয়াত ২৮)।
সুসন্তান যেমন মা-বাবার জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের বড় সম্পদ এবং সদকায়ে জারিয়া, তেমনি সন্তান যদি দ্বীনি শিক্ষা না পায় কবরে থেকেও মা-বাবাকে তার গুনাহর ফল ভোগ করতে হবে। সে সন্তানই তখন আল্লাহর দরবারে আপিল করবে যে আমাকে দ্বীনি শিক্ষা দেয়নি, তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। তাই এ আমানতের হক আদায়ের প্রতি খুবই যত্নবান হতে হবে। হাদিস শরিফে এসেছে-‘জেনে রেখ, তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। পুরুষ তার পরিবারবর্গের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। তাদের ব্যাপারে তাকে জবাবদিহি করতে হবে।’ (সহিহ বুখারি ১/২২২ হাদিস ৮৯৩)।
বর্তামানে বেশির ভাগ মা-বাবা দুনিয়াবি বিষয়গুলো যেভাবে শিক্ষা দেয় আখিরাতকে, আল্লাহর বিধিবিধানকে ওইভাবে শিক্ষা দেয় না। বরং অনেক অভিভাবকই বাচ্চাদের খেলনাসামগ্রী মোবাইল ফোন দিয়ে দেয়, এতে করে বাচ্চারা কী শিক্ষা পায়?
যদি কেউ পরিণত বয়সে গিয়ে আল্লাহর অনুগত হয়ে ওঠে, তবে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু এতে করে শিশু বয়স থেকে দ্বীনের শিক্ষা পাওয়াটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সন্তান হলো বাবা-মায়ের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত। এ আমানতের যথাযথ হক আদায়ের প্রতি যত্নবান হতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানসন্ততিকে নামাজ আদায় করতে আদেশ করবে; যখন তারা ৭ বছর বয়সে পৌঁছবে। আর নামাজের জন্য তাদের শাসন করবে; যখন তারা ১০ বছর বয়সে পৌঁছবে। আর তখন তাদের জন্য আলাদা বিছানা বা শয্যার ব্যবস্থা করবে।’ (আবু দাউদ, মিশকাত)।
শিশু বয়সেই অল্প অল্প করে আল্লাহর পরিচয় শেখানো, নবিজি (সা.)-এর নাম শেখানো, গল্পে গল্পে তাঁর পরিচয় ও আখলাক তুলে ধরা পিতা-মাতার কর্তব্য। সালাম দেওয়া, নিয়মিত সালাত পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। ভালো কাজ করলে তাকে উপহার দিয়ে উৎসাহিত করা। রমজান মাসে বাচ্চাদের রোজা রাখতে উদ্বুদ্ধ করা। অনেক বাচ্চা আছে রোজা রাখতে চায়, কিন্তু বাবা-মা রাখতে দেয় না। এটা ঠিক নয়। একদিন বাচ্চা না খেয়ে থাকলে মারা যাবে না, বরং তাকে ট্রেনিং দিন। ডিসেম্বরে যখন বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ থাকে তাদের নিয়ে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করুন। কষ্টকর ইবাদতগুলোয়ও ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করুন। তার স্পিরিটকে কাজে লাগান।
মুসলিম শিশু হিসাবে ধর্মীয় এ বিষয়গুলো প্রথমে শিক্ষা দেওয়া উচিত এতে ইসলামের সৌন্দর্য প্রকাশ পাবে। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে নিজ নিজ সন্তানদের শিশু বয়স থেকে ইসলামি শিক্ষায় গড়ে তোলার তাওফিক দান করুন। আমিন।