Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

রাসূল (সা.)-এর বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও বৈশ্বিক সফর

Icon

আসআদ শাহীন

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাসূল (সা.)-এর বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও বৈশ্বিক সফর

রাসূল (সা.)-এর বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও বৈশ্বিক সফর

রাসূল (সা.) কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কুরাইশরা ছিল প্রাচীন ব্যবসায়ী গোত্র। তাই রাসূল বাণিজ্যিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন এ কথা অনায়াসে বলা যায়। বাণিজ্যের জন্য দেশে-বিদেশে ভ্রমণ করতেন তিনি । চাচা আবু তালিব ছিলেন বড় ব্যবসায়ী। তিনি তাকে নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। এ ভালোবাসার কারণেই রাসূল (সা.)কেও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতেন।

প্রথম বাণিজ্যিক সফর

রাসূল (সা.)-এর বয়স যখন ১২ বছর ২ মাস তখন চাচা আবু তালিব কুরাইশের বাণিজ্যিক কাফেলার সঙ্গে সিরিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে সফরের কষ্টের কারণে রাসূল (সা.)কে তার সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু সফরে রওয়ানা হওয়ার সময় রাসূল (সা.)-এর চেহারায় বিষণ্নতা ও মলিনতার চিহ্ন দেখতে পেয়ে তিনি রাসূল (সা.)কে সঙ্গে নিয়েই রওয়ানা হলেন এবং যখন তিনি বুসরা শহরে পৌঁছলেন, তখন সেখানে একজন খ্রিষ্টান (কিছু ইহুদির মতে) পাদ্রি ছিলেন। যার নাম ছিল জর্জেস তবে সে বুহায়রা রাহেব হিসাবে বেশি প্রসিদ্ধ। পথিমধ্যে রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে বুহায়রার সাক্ষাৎ হলে সে নবিজি (সা.)-এর চেহারায় নুর এবং নবুওয়্যাতের আলামত দেখতে পায় এবং রাসূল (সা.)কে আগত নবির ভবিষ্যদ্বাণীর উদাহরণ হিসাবে দেখতে পায়। তাই সে হজরত আবু তালিবকে জোর দিয়ে বলল, এই ছেলে বড় হয়ে অনেক বড় মর্যাদার অধিকারী হবে, সেজন্য তাকে সিরিয়ার ইহুদি শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। অতঃপর হজরত আবু তালিব অবিলম্বে রাসূল (সা.)কে মক্কায় ফেরত পাঠান। (তারীখে তাবারি, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা-১১, আস সিরাতুন নববিয়্যাহ ওয়া আদ দাওয়াহ ফিল আহদি মক্কা, পৃষ্ঠা-২০৮)।

বাণিজ্যিক তৎপরতা

মহানবি (সা.)-এর প্রকৃত পারিবারিক পেশা ছিল ব্যবসা এবং তিনি শৈশবে চাচা আবু তালিবের সঙ্গে বহুবার বাণিজ্যিক ভ্রমণ করেছেন, যার কারণে তিনি বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে অনেক অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা ও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তিনি বাণিজ্যে খুবই আগ্রহী ছিলেন এবং তিনি তার প্রিয় চাচা আবু তালিবের কাঁধে বোঝা হয়ে চাপতে চাননি তাই তিনি ব্যবসার প্রতি ঝুঁকে পড়েন এবং জীবিকার জন্য এ পেশাই গ্রহণ করেন। তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া, বসরা ও ইয়েমেন ভ্রমণ করেন এবং এমন সততা, আমানত ও আস্থার সঙ্গে ব্যবসা করেন, তার সহযোদ্ধা এবং বাজারের সবাই তাকে ‘আমিন’ (বিশ্বস্ত) উপাধিতে ভূষিত করে। একজন সফল ব্যবসায়ীর জন্য বিশ্বস্ততা, সত্যবাদিতা, প্রতিশ্রুতি পালন এবং উত্তম চারিত্রিক-নৈতিকতা হলো ব্যবসার প্রাণ। রাসূল (সা.)-এর ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচারের গুণাবলি প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে গেঁথে যায় এবং মক্কার বড় বড় ব্যবসায়ী ও ধনী লোকেরা এ প্রত্যাশা করে যে, তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম রাসূল (সা.) পরিচালনা করে সমুজ্জ্বল করুক। রাসূল (সা.) সায়েব বিন কায়েস মাখজুমীর মাল ও অর্থ দিয়ে ব্যবসা করেন; বরং তিনিই তাকে ‘তাজিরুল আমিন’ (বিশ্বস্ত ব্যবসিক) উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। (আল হাদায়িকুল আনওয়ার ওয়া মাতালিউল আসরার ফি সিরাতিন নাবিয়্যিল মুখতার, পৃষ্ঠা-৫১৫)।

রাসূল (সা.)-এর ব্যবসার প্রশংসা

রাসূল (সা.) যে কোনো লেনদেন সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে করতেন এবং প্রতিটি লেনদেনে তিনি সত্য প্রতিশ্রুতি দিতেন এবং যে প্রতিশ্রুতি দিতেন তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পূরণ করতেন। (সিরাতে মোস্তফা, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা-৯৬)। হজরত আব্দুল্লাহ বিন সাইব (রা.) বলেন, জাহিলি যুগে রাসূল (সা.) ব্যবসায় আমার অংশীদার ছিলেন এবং সর্বোত্তম অংশীদার ছিলেন। না তিনি কখনো আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন আর না আমার সঙ্গে বিবাদ করেছেন। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস-২২৮৭)।

দ্বিতীয় বাণিজ্যিক সফর ও বিয়ে

তৎকালীন সময়ে মক্কার সবচেয়ে ধনী মহিলা ছিলেন হজরত খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রা.)। ইতঃপূর্বে যিনি দুবার বিধবা হয়েছেন। তিনি তার পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে বহু সম্পত্তি লাভ করেছিলেন এবং যিনি সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে ও ত্বরান্বিত করতে তার এমন একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তির প্রয়োজন ছিল, যিনি ব্যবসায়িক দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার অধিকারী হবেন। যদিও রাসূল (সা.)-এর বয়স ছিল প্রায় ২৩ বছর; কিন্তু তার উত্তম চরিত্র ও গুণাবলি ইতোমধ্যে মক্কার অলিতে-গলিতে চর্চা শুরু হতে থাকে এবং ব্যবসায়িক বুদ্ধিমত্তাও প্রসিদ্ধির শিখরে আরোহণ করে। (সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা-১১৮, আস সহিহ মিন সিরাতিন নববিয়্যিল আজম, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা-১৭৬)।

রাসূল (সা.) বাণিজ্যিক কাফেলার সঙ্গে সিরিয়ায় গিয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্যের অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছিলেন। তাই হজরত খাদিজা (রা.) তার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, রাসূল (সা.) তার বাণিজ্যিক পণ্য সিরিয়ায় নিয়ে যান এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, তিনি অন্য লোকদের তুলনায় রাসূল (সা.)কে বেশি মুনাফা প্রদান করবেন। রাসূল (সা.) চাচা আবু তালিবের সঙ্গে পরামর্শ করার পর এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং ২৩ অথবা ২৪ বছর বয়সে দ্বিতীয়বার বাণিজ্যিক সফরে সিরিয়ায় যান। (আস সহিহ মিন সিরাতিন নববিয়্যিল আজম, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা- ১৯৮, তবাকাতে ইবনে সাদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা-১২১)।

সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় রাসূল (সা.) মক্কায় অবিলম্বে বিক্রি করা যেতে পারে এমন পণ্যগুলো খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করলেন এবং সেগুলো পরে মক্কায় এসে বিক্রি করে অধিক মুনাফা লাভ করলেন। হজরত খাদিজা (রা.) সিরিয়ায় যাওয়ার সময় তার সম্পদ যখন রাসূল (সা.)কে সোপর্দ করছিলেন, তখন তিনি তার বিশ্বস্ত গোলাম মাইসারাকেও সঙ্গে পাঠালেন, যাতে সে রাসূল (সা.)-এর খেদমত ও সেবা করে। তবে মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল এই, যাতে সে সম্পদের প্রতি নজর রাখে এবং মহানবি (সা.)-এর অভ্যাস ও নৈতিকতার প্রতিও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। (হায়াতে মুহাম্মাদ সা. পৃষ্ঠা-৮৬-৮৭, আল হাদায়িকুল আনওয়ার ওয়া মাতালিউল আসরার ফি সিরাতিন নাবিয়্যিল মুখতার, পৃষ্ঠা-৫১৫)।

সিরিয়ার বাণিজ্যিক সফর থেকে ফিরে আসার পর মহানবি (সা.) ব্যবসার মুনাফা হজরত খাদিজা (রা)কে সোপর্দ করেন এবং মাইসারা শুধু রাসূল (সা.)-এর আমানতদারি ও বিশ্বস্ততারই প্রশংসা করে ক্ষান্ত হয়নি; বরং সে রাসূল (সা.)-এর সাধারণ নৈতিকতা ও চরিত্রের এমনভাবে প্রশংসা করেছে যে, হজরত খাদিজা (রা.) যিনি তার জীবনের এ শেষ সময়টিকে একজন ধার্মিক ব্যক্তির হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রাসূল (সা.)-এর উত্তম আদর্শ, চরিত্র, আমানতদারিতা ও বিশ্বস্ততা দেখে নবিজি (সা.)-এর সঙ্গে বিয়ের তামান্না করলেন। অতঃপর সিরিয়া থেকে ফেরার দুই মাস পঁচিশ দিন পর হজরত খাদিজা (রা.) রাসূল (সা.)কে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন এবং রাসূল (সা.) তার চাচার পরামর্শে তা কবুল করেন আর পঁচিশ বছর বয়সে তিনি তার চেয়ে পনেরো বছরের বড় এবং বিধবা মহিলাকে বিয়ে করলেন। (আদ দুররাতুল মুদিয়্যাহ ফি আস সিরাতিন নববিয়্যাহ, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা-৬, সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা-১৮৯)।

বিয়ের পর হজরত খাদিজা (রা.) রাসূল (সা.)কে তাঁর সব সম্পদ সোপর্দ করেন। কিন্তু তিনি তার সব সম্পদ গরিব, বিধবা ও এতিমদের মাঝে বিলিয়ে দেন এবং পরিবার চালানোর জন্য নিজের ব্যবসা অব্যাহত রেখে জীবিকা নির্বাহ করেন। আর বাণিজ্যের খাতিরে তিনি বসরা, মদিনাসহ বৈশ্বিক বাণিজ্য সফর করেন এবং এ সফরের মাধ্যমে তিনি কুরাইশদের বাণিজ্য রুটের প্রতিটি অলিগলি ও মোড় ভালোভাবে আয়ত্ত করেন; বিশেষ করে মদিনার রাজনৈতিক ও ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে বেশি অবগত হোন। (মুকতাতফাতু মিন সহিহিস সিরাতিন নববিয়্যাহ, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা-১০, ফিকহুস সিরাহ, পৃষ্ঠা- ৫৯)।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম