অপপ্রচার রোধে ইসলামের হুঁশিয়ারি
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইসলামে গুজব ও অপপ্রচার যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি সামাজিকভাবেও কাজটি ঘৃণিত। তথ্য প্রযুক্তির এ অবাধ প্রবাহ একদিকে মানুষের জীবনকে করেছে সহজ ও উপভোগ্য, অন্যদিকে একশ্রেণির অসাধু মানুষ তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার করে সমাজে ছড়াচ্ছে মিথ্যা গুজব বা অপতথ্য; যা মানুষের মধ্যে তৈরি করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, পারস্পরিক বিভেদ বিনষ্ট করে সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা। এমনকি মানুষকে ধাবিত করে ধর্ষণ, হত্যা ও গণহত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধে।
ইসলামের দৃষ্টিতে তথ্য একটি পবিত্র আমানত। প্রতিটি আমানতের ব্যাপারে মহান রব্বুল আলামিনের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। যারা সমাজে গুজব রটিয়ে বা মিথ্যা তথ্য প্রচার করে সম্প্রীতি বিনষ্টে প্রয়াসী হয়, তারা খেয়ানতকারী, ফাসিক ও মুনাফিক। গুজব প্রতিরোধে ইসালামেরও রয়েছে চমৎকার দৃষ্টিভঙ্গি ও অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থান। ইসলামে গুজবের কোনো স্থান নেই এবং এ বিষয়টি ইসলামে খুবই গর্হিত কাজ হিসাবে চিহ্নিত। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে গুজব তথা মিথ্যা অপপ্রচারের ব্যাপারে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। গুজব ছড়িয়ে যারা মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে এবং সম্মানহানি করে, তাদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধানও রয়েছে ইসলামে।
গুজব মানেই ভিত্তিহীন কোনো কথার প্রচার। চাই তা মানুষ হাসানোর জন্য হোক বা মানুষের ভেতর ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য করা হোক। ইসলাম কোনো অবস্থায়ই তা সমর্থন করে না। ইসলামের শিক্ষা হলো, মানুষ সর্বতোভাবেই তা পরিহার করবে। বরং প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা সে বলবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে চুপ থাকে সে মুক্তি পায়।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৫০১)। অনেকের মধ্যে নিজের বিশ্বাস প্রচারের প্রবণতা দেখা যায়, যারা প্রচারিত কোনো সংবাদ নিজের মত, মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুকূলে হলে তা যাচাইয়ের প্রয়োজন বোধ করে না। পাওয়া মাত্রই প্রচার শুরু করে। ইসলাম এ প্রবণতা পরিহারের নির্দেশ দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সব শোনা কথা প্রচার ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৯২)।
হাদিস বিশারদরা এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, কোনো কথা শুনেই প্রচারের প্রবণতা মানুষকে মিথ্যায় লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ায়। ফলে সে পৃথিবীতে লজ্জিত হয় এবং পরকালেও তার জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান। সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত অনেক সংবাদের সঙ্গে সামাজিক স্বার্থ জড়িত থাকে। এমন সংবাদের প্রচার মানুষকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে রক্ষা করে এবং কখনো কখনো বড় ধরনের বিপর্যয় থেকেও আত্মরক্ষার উপলক্ষ্য হয়। এমন জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারেও ইসলামের নির্দেশনা হলো, সংবাদ প্রচারের আগে অবশ্যই তা যাচাই করে নিতে হবে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের কাছে যদি কোনো ফাসেক ব্যক্তি কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তা যাচাই করো। অজ্ঞতাবশত কোনো গোষ্ঠীকে আক্রান্ত করার আগেই, (না হলে) তোমরা কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।’ (সূরা হুজুরাত, আয়াত : ৬)।
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ, অন্তরের প্রতিটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৩৬)। যে নেতিবাচক সংবাদের সঙ্গে সমাজ, জাতি ও উম্মাহর স্বার্থের সম্পর্ক নেই-শুধু ব্যক্তিগত রাগ, ক্ষোভ ও অভিমান থেকে হয়ে থাকে, তা প্রচার করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা তা অপবাদের স্তরভুক্ত হবে। পবিত্র কুরআনে অপবাদের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি রয়েছে। এমন নেতিবাচক সংবাদের যদি কোনো ভিত্তিও থেকে থাকে, তবে তা গিবত বা পরনিন্দা বিবেচিত হবে। শরিয়তে গিবতও জঘন্যতম অপরাধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা পরস্পরের দোষচর্চা করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? নিশ্চয়ই তোমরা তা অপছন্দ করবে। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সূরা হুজুরাত, আয়াত : ১২)।
গুজব ছড়ানোর পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য থাকে মানুষকে বিভ্রান্ত করা। তাদের আতঙ্কিত করা। মানুষের ভেতর বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করাকে কুরআনে মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তারা তোমাদের সঙ্গে বের হতো, তবে শুধু বিভ্রান্তিই বৃদ্ধি পেত। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য তারা তোমাদের ভেতর ছোটাছুটি করত। তোমাদের ভেতর তাদের কথা শোনার (বিশ্বাস করার) লোক রয়েছে। আল্লাহ অত্যাচারীদের সম্পর্কে অবগত আছেন।’ (সূরা তাওবা, আয়াত : ৪৭)।
সমাজে বা সামাজিক মাধ্যমে এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে মুসলিম সমাজের উচিত তাতে আক্রান্ত না হওয়া। তার প্রসারে সহযোগিতা না করা। বরং যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে তা সমাধানের চেষ্টা করা। পবিত্র কুরআনেও এমনটাই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদের কাছে নিরাপত্তা বা ভয়ের কোনো সংবাদ পৌঁছে, তখন তারা তা প্রচার করে। যদি তারা তা (সংবাদটি) রাসূল বা তাদের দায়িত্বশীল ব্যক্তির দৃষ্টিগোচর করত, তবে তাদের (দায়িত্বপ্রাপ্ত) অনুসন্ধানকারীরা তার যথার্থতা নির্ণয় করতে পারত। তোমাদের প্রতি যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত না থাকত, তবে সামান্য সংখ্যক ছাড়া সবাই শয়তানের অনুসরণ করত।’ (সূরা : নিসা, আয়াত : ৮৩)।
আমাদের সমাজে বিভিন্ন বিষয়ে অপপ্রচার মহামারি আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে এটা প্রতিপক্ষকে দমনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। কোনো ব্যক্তি অথবা কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো দলকে জনসাধারণের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করতে অপপ্রচারের বিকল্প নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে কারও বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে তার সম্মানহানি করা জঘন্য পাপ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ভুল করে কিংবা কোনো পাপ করে অতঃপর কোনো নির্দোষ ব্যক্তির প্রতি অপবাদ আরোপ করে, সে জঘন্য মিথ্যা ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সূরা নিসা : ১১২)।
যারা কোনো কথা শোনামাত্র সত্যতা যাচাই না করেই মানুষের কাছে প্রচার করে বেড়ায়, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের মিথ্যাবাদী হিসাবে গণ্য করেছেন। মিথ্যা হলো সব পাপের মূল। আর মিথ্যা মানুষকে জাহান্নামের পথে টেনে নিয়ে যায়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে কোনো কথা শোনামাত্রই (তার সত্যতা যাচাই না করেই) মানুষের কাছে বলে বেড়ায়।’ (আবু দাউদ : ৪৯৯২)।
আলোচ্য আয়াত থেকে গুজব রটানো শয়তানের কাজ বলেই প্রমাণিত হয়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসেও গুজবকে শয়তানের কাজ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘শয়তান মানুষের রূপ ধরে তাদের কাছে আসে এবং তাদের মিথ্যা কথা শোনায়। অতঃপর লোকজন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের কেউ বলে, আমি এমন এক ব্যক্তিকে এ কথা বলতে শুনেছি, যার চেহারা চিনি, কিন্তু নাম জানি না।’ (সহিহ মুসলিম)।