Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

কারবালার স্মৃতি নিয়ে এলো মহররম

Icon

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কারবালার স্মৃতি নিয়ে এলো মহররম

নবি করিম (সা.)-এর দৌহিত্র, হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) আশুরার দিনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইয়াজিদ সৈন্য বাহিনীর হাতে কারবালার প্রান্তরে শাহাদতবরণ করেন। ঘটনাটি ৬১ হিজরির ১০ মহররম সংঘটিত হয়েছিল।

এ মর্মান্তিক ঘটনাটি এতই লোমহর্ষক ও হৃদয় বিদারক যে, সারা বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান আজও তা ভুলতে পারেনি-পারবেও না। কিন্তু মাতম করলেই এ দিনের কর্তব্য শেষ হওয়ার নয় বরং আমাদের অন্যায়, জুলুম, অনাচার এবং পাপাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থেকে এগিয়ে যেতে হবে শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে।

হিজরি ৪০ সালের ১৭ রমজান শুক্রবার হজরত আলী (রা.) ৬৩ বছর বয়সে আবদুর রহমান ইবনে মুলজিম নামক আততায়ীর হাতে শাহাদতবরণ করেন। তিনি ৩ পুত্র রেখে যান-ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন (বিবি ফাতেমার গর্ভে) এবং মোহাম্মদ হানাফিয়া ইবনে আলী (২য় স্ত্রীর গর্ভে)।

ইমাম হাসান (রা.) কারবালার যুদ্ধের আগেই মৃত্যু মুখে পতিত হন। মোহাম্মদ হানাফিয়া ওই সময়ে জীবিত ছিলেন; কিন্তু ইমাম হোসাইনের সঙ্গে কারবালায় ছিলেন না। আমিরে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তার ছেলে ইয়াজিদ সব রাজ্যের (মদিনা, সিরিয়া, কুফা) ইত্যাদি শাসনভার গ্রহণ করে। তখন ইমাম হোসাইন মদিনায় ছিলেন। ইয়াজিদের শাসনভার গ্রহণের বিষয়ে তৎকালীন সময়ের অধিকাংশ সাহাবা একমত ছিলেন না। অনেকটা অস্ত্রের জোরে মুসলমানদের ক্ষমতা দখল করে।

ইয়াজিদ মদিনার গভর্নরের মারফত, ইমাম হোসাইন (রা.)কে ইয়াজিদের আনুগত্য স্বীকার করতে বলে। কিন্তু হজরত মোহাম্মাদ মোস্তফা (সা.)-এর দৌহিত্র, আদরের নাতি, একজন সাচ্চা ইমানদার হয়ে একজন ইসলামবিরোধী, জুলুমবাজ শাসকের আনুগত্য করা কি সম্ভব? স্বাভাবিকভাবে তিনি আনুগত্যে রাজি হননি।

তখন ইয়াজিদ মদিনার গভর্নরকে নির্দেশ দেয়, বাইয়াত গ্রহণ না করলে ইমাম হোসাইনকে কারাগারে নিক্ষেপ করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে। মদিনার গভর্নর তখন ভীষণ বিপদে পড়ে যান। তিনি কীভাবে প্রিয় নবিজির নাতিকে কারাগারে নিক্ষেপ করবেন? তিনি তখন হজরত ইমাম হোসাইনকে অনুরোধ করেন মদিনা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে। ইমাম হোসাইন বাধ্য হয়ে তখন মক্কায় হিজরত করেন। এহেন অবস্থায় কুফাবাসী চিঠির পর চিঠি দিয়ে ইমাম হোসাইনকে কুফা যাওয়ার অনুরোধ জানায় এবং ভরসা দেন যে, তিনি কুফা গেলেই সবাই তার বাইয়াত গ্রহণ করবেন।

এভাবে প্রায় দেড়শ চিঠি পাওয়ার পর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য নিজের চাচাতো ভাই হজরত ইমাম মুসলিম ইবনে আকিলকে তিনি কুফায় পাঠান। কুফাবাসী তাকে পেয়ে অত্যন্ত খুশি হন এবং তার হাতে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর পক্ষে বাইয়াত গ্রহণ করা শুরু করেন। মুসলিম ইবনে আকিল এতে অত্যন্ত খুশি হয়ে বাইয়াত গ্রহণের বর্ণনা দিয়ে, হজরত ইমাম হোসাইনকে (রা.) সপরিবারে কুফা আসার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠান।

হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) তখন পরিবারবর্গকে নিয়ে (৭২ জন সদস্য) কুফার উদ্দেশে যাত্রা করেন। এদিকে, ধূর্ত ইয়াজিদ কুফার গভর্নরকে পরিবর্তন করে সেখানে উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে নতুন গভর্নর করেন-সে ছিল হিংস্রতা, নির্মমতার এক জ্বলন্ত প্রতীক।

ইবনে জিয়াদ কুফায় এসে হজরত মুসলিম ইবনে আকিলকে শহিদ করেন এবং ৪ হাজার দুর্দান্ত সৈন্য দ্বারা কারবালা ঘিরে রাখেন, যাতে করে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) কুফা যেতে না পারে অর্থাৎ কারবালায় তাঁবু ফেলতে বাধ্য হন। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ৬০ হিজরির জিলহজ মাসের শেষের দিকে রওয়ানা হয়ে, ৬১ হিজরি মহররম মাসের ৮ তারিখে কারবালার প্রান্তরে পৌঁছান।

এদিকে ইয়াজিদের সৈন্য দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সেখানে তাঁবু ফেলতে বাধ্য হন তিনি। ইয়াজিদের সৈন্য বাহিনী ঘোষণা করে আনুগত্য স্বীকার করুন, নতুবা যুদ্ধ করুন। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) তখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করাই শ্রেয় মনে করলেন।

আশুরার দিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত একে একে ৭১ জন শহিদের লাশ ইমাম হোসাইন (রা.) কাঁধে বয়ে তাঁবুতে নিয়ে এলেন। এরপর নিজে লুটিয়ে পড়লেন যুদ্ধ করতে করতে।

শত্রুরা হজরত জয়নাবসহ রুগ্ণ শিশু, পুত্রহীনা ও বিধবা সর্বমোট ১২ জনকে এক শেকলে বেঁধে শেকলের এক মাথা হজরত জয়নুল আবেদিনের বাহুতে বেঁধে এবং অন্য মাথা হজরত জয়নাবের বাহুতে বেঁধে দেয়। ইয়াজিদ তাদের তপ্ত মরুতে এখানে-সেখানে, হাটে-বাজারে ঘুরিয়েছে, যাতে দুনিয়াবাসী জানতে পারে ইয়াজিদ বিজয় অর্জন করেছে। কিন্তু কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদ যদি ইমাম হোসাইনের পরিবারকে বন্দি না করত, তাদের নিয়ে বিজয় মিছিল না করত, তাহলে হয়তো ইমাম হোসাইনের শাহাদতের বিজয় কারবালার উত্তপ্ত ধুধু ধূলিকণার সঙ্গে উড়ে বেড়াত।

নবি পরিবারকে বন্দি অবস্থায় কুফা থেকে শতশত মাইল দূরে সিরিয়ায় মুয়াবিয়ার সবুজ রাজপ্রাসাদে আনা হলো। কিন্তু হজরত জয়নাব এত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার পরও ইয়াজিদের দরবারে এমন সাহসী ভূমিকা রাখলেন যে, পুরো দরবার কেঁপে উঠল। তার ভাষণ শুনে উপস্থিত সবাই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। ইয়াজিদও নিশ্চুপ হয়ে গেল। হজরত জয়নাবের তেজস্বী বক্তব্যে সিরিয়ায় বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখে চতুর ইয়াজিদ তার কৌশল বদলাতে বাধ্য হলো। বন্দিদের সসম্মানে মদিনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করল।

ইয়াজিদ তার প্রতিনিধি ইবনে জিয়াদকে কী নির্দেশ দিয়েছিল তা অপ্রকাশিত। কিন্তু ইবনে জিয়াদ যে ঘৃণ্য-জঘন্য কাজ করেছিল তাতে ইয়াজিদের পূর্ণ সমর্থন ছিল, তা তার পরবর্তী কার্যক্রমে প্রকাশ পেয়েছিল। কারবালার ঘটনা শুনে ইয়াজিদ অনুতপ্ত মনে দুঃখ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সেসবই ছিল ভণিতাপূর্ণ। মুখে এক রকম বললেও কাজ করেছিল বিপরীত। সে শহিদদের মস্তক মুবারকগুলোকে রাতে রাষ্ট্রীয় ভবনের শাহি দরজায় টাঙ্গানোর জন্য এবং দিনে দামেস্কের অলি-গলিতে ঘোরানোর নির্দেশ দিয়েছিল। তার নির্দেশ মতো মস্তক মুবারক দামেস্কের অলি-গলিতে ঘোরানো হয়েছিল।

এতে প্রমাণিত হয়েছে, ইয়াজিদ ভণিতাপূর্ণ দরদমাখা কথাবার্তা বলেছিল, যাতে লোকজন তার বিরুদ্ধে চলে না যায় এবং লোকেরা যেন মনে করে, সে এ ধরনের আচরণ করার পক্ষপাতি ছিল না।

কিন্তু ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিশ্লেষণ করলে এটি পরিষ্কার হয়ে যায়, হজরত আলী (রা.)-এর ইন্তেকালের পর হজরত ইমাম হাসান (রা.)কে বিষপানে শহিদ করা, কারবালার প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও রাসূল (সা.)-এর পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে নিঃসংকোচে হত্যা করা সবই অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছিল।

হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার না করে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধ করে শাহাদতবরণ করেন। কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনা সত্য-সুন্দর প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী চেতনাকে সমুজ্জ্বল করে রেখেছে, কারবালার শহিদানের স্মৃতি যুগ যুগ ধরে মানব জাতিকে সত্য ও ন্যায়ের পথে চিরদিন প্রেরণা জুগিয়ে আসবে।

লেখক : গবেষক, কলামিস্ট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম