মহাসত্যের সন্ধানে সালমান ফারসি (রা.)
মেরাজুল ইসলাম
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর একজন বিখ্যাত সাহাবি সালমান ফারসি (রা.)। রাসূল (সা.) তাকে সালমান আল খায়র নাম দেন। এ মহান সাহাবির সুদীর্ঘ জীবনীতে দেখা যায়, অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের সিঁড়ি পেরিয়ে মহানবি (সা.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করে গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেন।
অগ্নিপূজক বাবার গৃহ নির্মাণ পরিদর্শনের সূত্রপাত ধরে একদিন সত্যানুসন্ধানে নেমে পড়েন। প্রথমে গির্জার সন্ধান পেলেন। অদৃশ্য এক মালিকের কাছে কাকুতি মিনতি, সালাত আদায় ইত্যাদি। তার কাছে মনে হলো এসব তো অগ্নিপূজার চেয়েও শ্রেয়। শুরু হলো ভালোলাগা। ভালোবাসা।
বাবা সালমানের গতি-মতি দেখে বুঝতে পারলেন-সে অন্য ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। শিকলে বন্দি করলেন। এদিকে সালমান গির্জায় দূত পাঠালেন, সিরিয়া থেকে কাফেলা এলে তাকে যেন সংবাদ দেওয়া হয়। যথা সময়ে সংবাদ এলো। শিকল ভেঙে সালমান সিরিয়ায় চলে গেলেন। ইসফাহান থেকে সিরিয়ায়। জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে ধর্মপণ্ডিত কে? নাসারারা বললেন, গির্জার পাদ্রি।
পাদ্রির সঙ্গ পেতে সঙ্গী হওয়ার মনোবাসনা ব্যক্ত করলেন, পাদ্রিকে বললেন, এ ধর্মের প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। ভালো লেগেছে, অদৃশ্য এক সৃষ্টিকর্তার কাছে কাকুতি মিনতি, সালাত আদায় ইত্যাদি। আমি আপনার সঙ্গ পেতে চাই। আপনার খেদমত করে এ ধর্মের দীক্ষা পেতে সুদূর ইসফাহান থেকে সিরিয়ায় এসেছি। আপনি আমাকে গির্জায় থাকতে দিন। পাদ্রি থাকতে দিলেন। ধর্মের দীক্ষা দিলেন। কিন্তু জনতার সম্মুখে পাদ্রির ধর্ম প্রচার ও তার কাজে মিল না পাওয়াতে মন আবার উথালপাথাল হলো তার। সত্য পথ কোথায় পাই! খুঁজতে লাগলেন একজন ধর্মগুরু।
আশ্চর্য! হঠাৎ পাদ্রি মারাই গেলেন। তার স্থানে এলেন এক নিষ্কলুষ পাদ্রি। যিনি আখেরাতমুখী। অর্থের প্রতি কোনো লালসা নেই। কিছু দিন থাকলেন তার কাছে। ধর্মের দীক্ষা নিলেন। মৃত্যুপূর্ব ধর্মগুরুকে বললেন, আপনার তিরোধানের পর আমি কোথায় যাব। পাদ্রি বললেন, আমার মতো খাঁটি ধর্মের অনুসারী কাউকে দেখছি না। যারা আছেন তারা বিকৃতকারী, অর্থলোভী।
শোনো সালমান! তুমি ইরাক চলে যাও। মুসেলে। সেখানে আছে খাঁটি ধর্মের একজন অনুসারী। সঠিক ধর্মের দীক্ষা তার কাছে পাওয়া যাবে। সালমান ফারসি ইরাকের মুসেলে চলে এলেন। কিছু দিন থাকার পর এই পাদ্রিও পরপারে পাড়ি জমালেন। সন্ধান দিলেন ইরাকের নসীবেইনের এক ধর্মগুরুর। হজরতে সালমান ফারসি ছুটলেন সেই নসীবেইনের ধর্মগুরুর কাছে। কিছু দিন থাকার পর নসীবেইনের সেই পাদ্রিও মারা গেলেন।
সন্ধান দিয়ে গেলেন আম্মুরিয়ার এক পাদ্রির কথা। সালমান ছুটলেন নসীবেইন থেকে আম্মুরিয়া। আফসোস, কিছু দিন থাকার পর আম্মুরিয়ার পাদ্রিও মারা গেল। তবে মৃত্যুর প্রাক্কালে সালমান পাদ্রিকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি সঠিক সত্য ধর্মের সন্ধান কোথায় পাই? বাবা ছেড়েছি, পিতার অঢেল ভূসম্পদ ছেড়েছি, জন্মভূমি ছেড়েছি। ইসফাহান, সিরিয়া, মুসেল, নসীবেইন সব পাড়ি দিয়ে এখন আম্মুরিয়া! ওহে ধর্মগুরু আপনি-ই বলুন, সত্য ধর্মের সন্ধান কোথায় পাই?
বললেন, আরব ভূখণ্ডে একজন নতুন নবির আবির্ভাবের সময় ঘনিয়ে এসেছে। জন্ম আরব ভূমিতে। হিজরত করবেন দুই মরুর মাঝে খেজুরের বাগানে ভরপুর জায়গায়। তিনি ইবরাহিম (আ.)-এর দ্বীনকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। সালমান! তাঁকে তুমি কীভাবে চিনবে? শোনো! তিনি সদ্কা খান না। হাদিয়া গ্রহণ করেন। দুই কাঁধের মাঝে নবুয়্যতের সিলমহর থাকবে। সত্য ধর্মের সঠিক সন্ধান পেতে চাইলে সেখানে চলে যাও।
আম্মুরিয়ায় নিজের পোষা ভেড়াগুলোর বিনিময়ে আরব বণিকদের সঙ্গে আরব ভূমিতে চলে গেলেন। আরব ভূমিতে যাওয়ার পথে ওয়াদী আল-কুরা নামক স্থানে বণিকরা তাকে বিক্রি করে দিল। শুরু হলো জমিদার পুত্রের গোলামি জীবন। কিছু দিন পর মনিব তাকে তার চাচাতো ভাইয়ের কাছে বিক্রি করে দিলেন। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো মদিনায়। শহর দেখা মাত্রই পাদ্রির বর্ণনায় সব মিলে গেল। হজরত সালমান ফারসি বলেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি শহর চিনে ফেললাম।’
একদিন নবিজির আগমন হলো। কিন্তু সালমান খবরটি জানলেন না। একদিন মনিবের খেজুর বাগানে পরিচর্যা করছিলেন। মনিবের চাচাতো ভাই এসে বললেন, আল্লাহর কসম! মক্কা থেকে কুবাতে একজন ব্যক্তি আগমন করেছেন। আর মানুষ তাঁকে নবি ধারণা করে দলে দলে তাঁর কাছে ভিড় জমাচ্ছেন। এ কথা শুনে সালমানের হৃদয় যেন আনন্দে ভরে উঠল।
তড়িঘড়ি খেজুরগাছ থেকে নিচে নেমে পড়লেন। মনে মনে কুবায় যাওয়ার মনস্থির করলেন, নবিজির সাক্ষাৎ যেন তাকে চুম্বকের মতো টানছে। নবিজিকে দেখা মাত্রই তার হৃদয়ে প্রেমের ঢেউ উঠল। জীবনের কত পথ মাড়িয়ে আজ সাধনার কাক্সিক্ষত মানুষের কাছে এসেছেন তিনি। একে একে দশজন মনিবের হাত বদল হয়েছেন। দীর্ঘ সংগ্রাম পাড়ি দিয়ে জমিদারের পুত্র এখন মদিনার কুবায়। সঙ্গে নিয়ে আসা কিছু খেজুর নবিজিকে দিলেন।
নবিজি খেজুর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সালমান বললেন, এগুলো আপনার জন্য সদ্কা। নবিজি খেলেন না। দরিদ্র সাহাবিদের দিয়ে দিলেন। সালমান পাদ্রির বর্ণনা মোতাবেক সত্য খুঁজে পেলেন। ভাবলেন এটি পাদ্রি বন্ধুর বর্ণনার প্রথম আলামত। হৃদয়ে জন্ম নিল অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা। অন্য দিন দরবারে এসে বললেন, এগুলো আপনার জন্য হাদিয়া। নবিজি গ্রহণ করলেন, হজরত সালমান ফারসি (রা.)-এর বুঝতে বাকি নেই যে, তিনি আখেরি নবি। সালমান নবিজির মহরে নবুয়্যাত দেখে আর দেরি করলেন না; ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিলেন।