Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

ক্ষমা ও করুণার রাত শবেবরাত

Icon

মুহসিন আল জাবির

প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ক্ষমা ও করুণার রাত শবেবরাত

আরবি অষ্টম মাস শাবানের চৌদ্দতম তারিখ দিবাগত রাত পবিত্র শবেবরাত। এ রাতে সূর্যাস্তের পর থেকে শেষ রাত পর্যন্ত মহান আল্লাহ পৃথিবীর প্রথম আকাশে এসে তাঁর বান্দাকে এ রকম মায়া আর দয়া নিয়ে ডাকতে থাকেন। যারা তাঁর এ ডাকে সাড়া দিয়ে প্রার্থনায় লিপ্ত হয়, তারা কল্যাণকামী হয়। সৌভাগ্যবান হয়।

তিনি ডাকেন-কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছ কি? আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি ক্ষমা করে দেব। কারও রিজিকের প্রয়োজন আছে কি? আমার কাছে চাও, আমি রিজিক দেব। কোনো বিপদগ্রস্ত আছ কি? আমার কাছে মুক্তি চাও, আমি বিপদমুক্ত করে দেব! নবিজি (সা.) মুসলিম উম্মাহকে এ রাতে অধিক পরিমাণে নফল ইবাদত এবং পরের দিন রোজা রাখার উপদেশ দিয়েছেন (ইবনে মাজাহ)।

মানুষ ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, শয়তানের কুমন্ত্রণায়, প্রবৃত্তির তাড়নায় বিপথগামী হয়ে পড়ে, পাপাচারে লিপ্ত হয়। মানুষের পাপ মোচনের জন্য আল্লাহ তওবা ও ইস্তিগফারের ব্যবস্থা রেখেছেন। বিশেষ কিছু দিবস ও রজনি দিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো শবেবরাত। শব অর্থ রাত, বরাত অর্থ মুক্তি; শবেবরাত মানে মুক্তির রাত। কিছু অভিশপ্ত লোক ছাড়া আল্লাহতায়ালা এ রাতে সবাইকে ক্ষমার সুযোগ করে দেন। মহান আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমার সুযোগ পেতে হলে এ রাত নবিজির মতো ইবাদত ও বিনয়ের সঙ্গে কাটাতে হবে।

একবার নবিজি (সা.) রাতে নামাজে দাঁড়ালেন। তিনি নামাজে এত দীর্ঘ সময় সিজদা করলেন, হজরত আয়েশা (রা.) ভাবলেন, তিনি মারা গেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি তখন নবিজির পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ে উঠল। তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আয়েশা!

তোমার কী হয়েছে? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার তো মনে হয়েছিল আপনি মারা গেছেন! নবিজি (সা.) বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আপনি তো আল্লাহর রাসূল; আল্লাহ এবং আপনিই তো ভালো জানেন। তখন নবিজি (সা.) বললেন, এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত তথা শবেবরাত। এ রাতে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেন; ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীরা মহান আল্লাহর এ অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয় (শোয়াবুল ইমান)।

নবিজি (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া করতেন। ইস্তিগফার পড়তেন। এ রাতে মহান আল্লাহ অধিকসংখ্যক পাপীকে ক্ষমা করে দেন (জামে তিরমিজি)।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি ‘বরকতময় রাতে’। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত করা হয়।’ (সূরা দুখান : ২-৩)। বিখ্যাত তাফসিরবিদদের মতে, ‘বরকতময় রাত’ মানে শবেবরাত। মহান আল্লাহ শবেবরাতে সবকিছুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শবেকদরে নির্দিষ্ট কিছু লোককে সেসব বিষয়ে দায়িত্ব অর্পণ করেন (তাফসিরে কুরতুবি)।

এ বছর কারা জন্মগ্রহণ করবেন এবং কারা মারা যাবেন, তা লিপিবদ্ধ করা হয় শবেবরাতেই। এ রাতেই মানুষের আমল পৌঁছানো হয়। এ রাতেই মানবজাতির রিজিকের বাজেট করা হয় (বায়হাকি)।

আমাদের উচিত এ রাতে অধিক পরিমাণে তসবিহ পড়া, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া ও কুরআন তেলাওয়াত করা। আমরা এ রাতে মহান আল্লাহর কাছে নিজের প্রয়োজনের কথা বলব। নফল নামাজ পড়ব। কাজা আদায় করব। শবেবরাতের নির্দিষ্ট কোনো নামাজ নেই। তবে এ রাতে কবর জিয়ারতের বিশেষ ফজিলত রয়েছে।

শবেবরাতে নফল ইবাদতগুলো অতিউত্তম, মহামারির কারণে পরিস্থিতি এখন অন্যরকম। তাই শবেবরাতের সব নফল ইবাদত ঘরেই করা উচিত। ইসলামে নফল ইবাদত ঘরে আদায় করা উত্তম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের উচিত অপ্রয়োজনে সময় ব্যয় না করে এ পবিত্র রজনিতে আল্লাহর ইবাদত-বন্দিগিতে আত্মনিয়োগ করা।

তাহিয়াতুল ওজু, দুখুলিল মাসজিদ, আউওয়াবিন, তাহাজ্জুদ, সালাতুততাসবিহ, সালাতুলহাজাত ও অন্যান্য নফল নামাজ করা। কারণ নফল ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো নামাজ। প্রতিটি নফল ইবাদতের জন্য তাজা ওজু বা নতুন ওজু করা মোস্তাহাব। অত্যধিক নফল নামাজ এ রাতের শোভাবর্ধন করে। আমাদের উচিত নামাজে কিরাত ধীরগতিতে পড়া। রুকু-সিজদা দীর্ঘ করা। অধিক পরিমাণে কুরআন তেলাওয়াত করা। দরুদ শরিফ পড়া। অধিক পরিমাণে তাওবা-ইস্তিগফার করা। তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আসকার ইত্যাদি ইবাদতে মগ্ন থাকা। নিজের জন্য, পিতামাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের জন্য, সব মুমিন মুসলমান এবং দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা।

মহান আল্লাহর কাছ থেকে আমাদের পাপ মোচন করানো এবং ভাগ্যোন্নয়নের জন্য প্রার্থনা করার এটাই শ্রেষ্ঠ সুযোগ। অহেতুক অবহেলায় সময় নষ্ট না করে এ রহমত ও বরকতের পবিত্র রাতকে বিভিন্ন নফল ইবাদতের মাধ্যমে সাজানোটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এমন সৌভাগ্যময় রাত জীবনে আর না-ও আসতে পারে। আমাদের অনেকেই রোগবালাইয়ে আক্রান্ত, বিপদগ্রস্ত, অভাব-অনটনে পতিত-এসব থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার এটাই উপযুক্ত সময়। এ রাতের আরেকটি ভালো আমল হলো আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর কবর জিয়ারত করা।

‘কবর জিয়ারত দ্বারা জিয়ারতকারীর উপকার হয়। কবর দেখে সে আখিরাতমুখী হওয়ার সুযোগ পায়। নবিজি (সা.) বলেছেন, ‘আমি ইতঃপূর্বে তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা কবর জিয়ারত করো। এটা পরকালকে স্মরণ করিয়ে দেয় (মুসলিম)। আমরা অনেকেই জানি প্রতিটি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে তিনটি নফল রোজা রয়েছেই, যা হজরত আদম (আ.) পালন করেছিলেন। তাছাড়া নবিজিও এ রোজা পালন করতেন, যা মূলত সুন্নত। সুতরাং এ তিনটি রোজা রাখলেও শবেবরাতের রোজা পালিত হয়ে যাবে। হাফিজ ইবনে রজব (রহ.) বলেন, এ দিনের রোজা চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজার অন্তর্ভুক্ত (লাতায়িফুল মাআরিফ)।

শাবান মাস হলো নবিজির প্রতি অগাধ ভক্তি, শ্রদ্ধা ও প্রেম-ভালোবাসা প্রদর্শনের মাস। তা হতে হবে সুন্নত অনুশীলনের মাধ্যমে। তাছাড়া নবিজি (সা.) শাবান মাসে সবচেয়ে বেশি নফল ইবাদত করতেন। নফল রোজা পালন করতেন। নফল নামাজ আদায় করতেন। বলা হয়-রজব মহান আল্লাহর মাস, শাবান নবিজির মাস। আর রমজান হলো উম্মতের মাস। নবিজি (সা.) রজব ও শাবান মাসে এ দোয়া বেশি বেশি পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজাবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রমাদান’। ‘হে আল্লাহ! রজব মাস এবং শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন; রমজান পর্যন্ত আমাদের জীবনদান করুন।’ (মুসনাদে আহমাদ)। শবেবরাতে আমরা এ দোয়াটি অধিক পরিমাণে পড়ব।

শবেবরাত হলো ইবাদতের রাত, দান-খয়রাতের রাত। আমরা জানি, মানুষকে খাওয়ানোও এক ধরনের ইবাদত; তাই বলে এই পবিত্র রাতটিকে শুধু হালুয়া-রুটিতে অতিবাহিত করা আদৌ বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আবার অনেকে তো আতশবাজি ও পটকা ফোটানোর মতো অহেতুক কাজগুলোও করে থাকেন। ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়ে অহেতুক ঘোরাফেরা করেন, আনন্দ-উল্লাস করেন।

অন্যের ইবাদতের বিঘ্ন ঘটান, নিজের ইবাদত থেকে বঞ্চিত হন। যারা এ পবিত্র রাতে এসব করে বেড়ান, পৃথিবীতে তাদের চেয়ে হতভাগা আর কে হতে পারে! নবিজি (সা.) বলেন, শবেবরাতে মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন। মুশরিক ও হিংসুকবিদ্বেষী লোক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন (সহিহ ইবনে হিব্বান)। মহান আল্লাহ তো মহাক্ষমাশীল। তিনি আমাদের ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। তাই তো ক্ষমার জন্য তিনি রেখেছেন বিভিন্ন উপলক্ষ্য; বান্দার জন্য বিভিন্ন সুযোগ। আর সেই সুযোগেই তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। প্রয়োজন শুধু ফিরে আসার। তওবার মাধ্যমে তাঁর দুয়ারে ধরনা দেওয়ার। শুধু ক্ষমা নয়, ক্ষমা করে তিনি টেনে নেন রহমতের ছায়ায়; এমনকি কখনো পাপের সংখ্যা পরিবর্তন করে দেন পুণ্য দিয়ে। আমাদের শুধু একটু এগিয়ে আসতে হবে। পাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর কাছে তওবা করতে হবে, ক্ষমা চাইতে হবে। ক্ষমা করে দেওয়ার বিভিন্ন উপলক্ষ্য ও সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। শবেবরাত হলো সে রকমই একটা মহাসুযোগ। শবেবরাত হলো ক্ষমার রাত। এ রাতে আল্লাহ বান্দাকে ডাকেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছ কি? আমার কাছে ক্ষমা চাও-আমি ক্ষমা করে দেব। আর বান্দা যখন সে ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, মহান আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। পাপকে পুণ্যে পরিণত করেন। তওবা কবুল করেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিন। আমিন!

লেখক : মাওলানা, মুফতি, লেখক ও গবেষক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম