Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

আলোকিত জীবনের জন্য আধ্যাত্মিক সাধনা

Icon

কুলসুম রশীদ

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আলোকিত জীবনের জন্য আধ্যাত্মিক সাধনা

কুরআনে ‘তাসাওউফ’ শব্দটি আসেনি-কুরআনে এর প্রতিশব্দ হচ্ছে হিকমত-আল্লাহ তাঁর প্রিয়তমকে আমাদের মাঝে পাঠিয়েছেন এ হিকমত শিক্ষা দেওয়ার জন্য। আয়াতুল কুরসিতে এ হিকমতের কথা বলা হয়েছে।

একেই বলা হয় এলমে লাদুনি বা ইলমে জাত। আলেমে বিল্লাহ যারা তারাই এ জ্ঞানের অধিকারী। কুরআনে জাহেরি অর্থের পেছনে আছে একটি বাতেন-আর এ বাতেনে আছে সাতটি পর্দা। আর এসব জ্ঞানের গুপ্তমন্ত্র হচ্ছে কালিমা শরফি-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।

এ জন্যই সূরা মোহাম্মাদে বলা হচ্ছে, ফা’আলাম আন্নাহু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু-অর্থাৎ কালিমা শরিফকে নিবিড়ভাবে জানানোর চেষ্টা করা এর মধ্যে সৃষ্টির রহস্য লুকিয়ে আছে। হজরত আলী (রা.) এ রহস্যের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন মুমিনের জন্য যে বিদ্যাকে ফরজ করা হয়েছে তা হলো আল্লাহকে পাওয়ার বিদ্যা।

মজার কথা হলো যে, এ বিদ্যার কোনো কিতাব নেই। এ বিদ্যার আধার হচ্ছে মুমিনের কলব। ‘কেউ ক্ষমতা চাইলে সে জেনে রাখুক সব ক্ষমতা তো আল্লাহরই-তারই দিকে পবিত্র বাণীগুলো আরোহণ করে এবং সৎকর্ম তার মর্যাদাকে উন্নত করে’ (সূরা ফাতির ১০)।

সুতরাং কুরআনেই ইলমে তাসাওউফের কথা রয়েছে। আর সে সাধনায় রয়েছে চারটি স্তর। শরিয়ত পথ খোঁজ করার নাম, পথের সন্ধান পেয়ে যাওয়ার নাম তরিকত, পথে চলতে শুরু করার নাম হাকিকত এবং এ পথে যাকে খুঁজছ তাকে পেয়ে যাওয়ার নাম মারেফাত। সূরা মায়েদার ১৫ নম্বর আয়াতে ‘ইলম বিল জেনানের কথা এসেছে। (সৈয়দ রশীদ আহমেদ জৌনপরী (র.)-এর কুরআন, হাদিস ও সুফিতত্ত্বের ভূমিকা) হজরত মওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (র.) বলেছেন-কেবল শরিয়তে শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেম মারেফাতের আমল বিহনে ফাসিক।

মিশকাত শরিফে বর্ণিত আছে যে, ইলমে মারেফাত হাসিল না করলে পূর্ণ শরিয়ত আদায় হয় না। এটা ছাড়া অন্যটি অপূর্ণ এ কারণে ইমাম মালেক (র.) বলেছেন-‘যে ব্যক্তি কেবল ইলমে তাসাওউফ আমল করল কিন্তু ইলমে শরিয়ত আমল করল না সে জেন্দিক (কাফের)। আর যে ব্যক্তি কেবল শরিয়তের আমল করল কিন্তু তাসাওউফের আমল করল না ওই ব্যক্তি ফাসেক। যে ব্যক্তি উভয়কেই আমল করল সে ব্যক্তি সঠিক পথে আছে।

জড়বাদ বর্তমান যুগে সর্বত্র পরিব্যপ্ত। দৈহিক উপভোগ সবার লক্ষস্থল। আধ্যাত্মিক অর্থাৎ আত্মিক উন্নতির প্রতি অবজ্ঞা। পেটের ক্ষুধার মতো আত্মাও যে ক্ষুধায় ছটফট করে সে ব্যাপারে বিস্মৃত সাধারণ মানবকুল। ফলে উপবাসে আত্মা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়। ফলস্বরূপ সত্যকে অস্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। মানব সমাজ একই উৎসমূল থেকে এসে আবার একই উৎসে প্রত্যাবর্তন করবে।

আমাদের মাটির দেহে মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র রুহটি ফুঁকে দিয়েছেন। এ রুহই হচ্ছে তার আদেশ অর্থাৎ একটা শক্তি, যা মাটির দেহকে সচল রাখে। এটাই তার আত্মা, তার আধ্যাত্মিক শক্তি। অপরদিকে মানবদেহের মাঝে এক চৌম্বকত্ব সৃষ্টি হয়ে আত্মার পানে অগ্রসর হতে থাকে এবং নিজেকে চেনার কাজে অগ্রসর হতে চায়। এ পথের চূড়ায় পৌঁছাতে গেলে তাকে অনেক সাধনায় লিপ্ত হতে হয়। শরীরের সাহায্যে ওই শক্তির বিকাশ মানবজীবনের একমাত্র লক্ষ্য।

এ দেশে ইসলাম প্রচারের পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। তাই কোনো কোনো সুফিকে সত্য প্রচারের জন্য রুহানি শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছিল। আবার সময়ে অলৌকত্ব প্রদর্শন করে ভণ্ডদের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে হয়েছিল। নিপীড়িত মজলুমদের শান্তির পথ, রুহানিয়াতের পথ দেখানোর জন্য এক হাতে শরিয়ত অন্য হাতে মারেফাত নিয়ে এসেছিলেন তারা।

ইসলামি হুকুমের নাম শরিয়ত। আর সে অনুযায়ী চলার নাম তরিকত। তরিকতের মাধ্যমেই মারেফাত অর্জিত হয়। কলবকে সংশোধন করতে হলে তাসাওউফের কোনো বিকল্প নেই। কারণ তাসাওউফ কলবের বিবেচনা শক্তিকে সুদৃঢ় করে। কলবের নুর প্রজ্বলিত করে এবং কলবকে পবিত্র করে। এ পথে পথিক হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে শুধু মুসলমান হলেই চলবে না। তাকে মুমিন হতে হবে অর্থাৎ মহান রাব্বুল ইজ্জতের কাছে এবং তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.)-এর কাছে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করা। তবে এর আগে তার রুজিটি হালাল হতে হবে। ‘ওগো নবিরা তোমরা হালাল বস্তু ভক্ষণ কর এবং নেক কাজ কর (সূরা মুমিনুন ৫১)।

মুমিনগণের উদ্দেশে আল্লাহপাক সূরা হাদিদের ২৮নং আয়াতে জানিয়েছেন ‘হে মুমিনরা তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং রাসূলে বিশ্বাস স্থাপন করো। তিনি তার রহমতের দ্বিগুণ অংশ তোমাদের দেবেন এবং তোমাদের দেবেন জ্যোতি যার সাহায্যে তোমরা পথ চলবে এবং আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়াময়। ‘ইত্তাকুল্লাহ’ এ শব্দটি পবিত্র কুরআন পাকে ৭০০ বার এসেছে শব্দটিতে ভয়ভীতি প্রেম সবই আছে। এ ছাড়া কুরআন পাকে বহু স্থানে আছে আল্লাহকে অনুসরণ কর এবং তাঁর রাসূলকে অনুসরণ কর।

একটি ছাড়া অপরটি অপূর্ণ। এভাবে আমরা আল্লাহ ও রাসূলের অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত আমাদের ওপর বর্ষিত হতে থাকবে। বর্তমান তাসাওউফের অনুসারী পির প্রথা বলে সমাজে প্রচলিত রয়েছে। একাধিক পথ-বিচ্যুত পির সাহেব আত্মিক জ্ঞানার্জনের পন্থা ত্যাগ করে পার্থিব সম্পদ ও প্রতিপত্তি অর্জনকে প্রাধান্য দিয়েছেন। যার ফলস্বরূপ তারা পূজিত হচ্ছেন ত্রাণকর্তারূপে, সত্যিকারের সুফিরা ইসলামের সেবক ছিলেন।

ইমানে রাব্বানী হজরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী (র.) পানাহারের আগে অতিথি লাভের জন্য অপেক্ষায় থাকতেন। ভণ্ড পিররা দাওয়াত গ্রহণ করতে ব্যস্ত। আর পক্ষান্তরে দেখা যায় সুফি সাধকরা ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে জনসাধারণের দ্বারে দ্বারে গিয়ে। নিজ অর্থ ব্যয়ে।

রাসূল (সা.) শরিয়তের সঙ্গে গুপ্ত জ্ঞান শেখানোর জন্য তাহাজ্জুদের নামাজের পর উসতে হান্নানা নামক জায়গায় বিশিষ্ট সাহাবিদের নিয়ে যেতেন। এদের ‘আসহাবে সিরর’ বলা হয়। এদের সংখ্যা ৭/১১ জন। এদের মধ্যে ছিলেন হজরত আলী (রা.) হজরত আবু বকর (রা.) হজরত কুমায়ের বিন জেয়াদ, হজরত সালমান ফারসি, হজরত আবুজর গিফারি (রা.) তাদের তিনি ব্যক্তিগতভাবে ইলমে তাসাওউফ শিক্ষা দিয়েছিলেন।

এ জ্ঞানই অন্তর থেকে অন্তর হয়ে চলে এসেছে গওস পাক হজরত মহিউদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানি পর্যন্ত। তারপর তারই মাধ্যমে এ জ্ঞান এখনো জারি রয়েছে। এর সঙ্গে শরিয়তের কোনো বিরোধ নেই। শরিয়ত ছাড়া এ জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। শরিয়ত ও তরিকত পালনের মাধ্যমে বেলায়েত পাওয়ার আশা করা যায়।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম