আলোকিত সমাজ গঠনে শিশুদের মসজিদমুখী করুন

শামসীর হারুনুর রশীদ
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আলোকিত সমাজ গঠনে শিশুদের মসজিদমুখী করুন
শিশুদের মসজিদমুখী করুন। কিছুটা বুঝতে শিখেছে এমন শিশুকে মসজিদে নিয়ে যাওয়া একটি প্রশংসনীয় কাজ। ছেলেবেলা থেকে মসজিদে যাওয়ার অভ্যাস শিশুমনে দারুণ প্রভাব ফেলে। শিশুদের সঠিকভাবে নামাজ শেখানো রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত। মা-বাবা, শিক্ষক কিংবা অন্য যে কেউ নামাজ পড়ার সময় শিশুদের তা শিখিয়ে দিতে পারেন। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করে বলেন, এক রাতে আমি নবিজির পেছনে বাম পাশে নামাজে দাঁড়িয়েছিলাম। তিনি নামাজরত অবস্থায় আমাকে তাঁর হাত দিয়ে টেনে নিজের ডান পাশে দাঁড় করিয়ে দেন (সহিহ বুখারি : ১১৭)। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) অন্য একটি বর্ণনায় বলেন, একদিন ফজরের নামাজের ইকামত হয়ে যাওয়ার পর আমি দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে যাই। তখন জামাত শুরুর আগে আল্লাহর রাসূল (সা.) এসে আমার হাত ধরে ফেলেন। এরপর বলেন, তুমি ফজরের নামাজ চার রাকাত পড়বে না কি? (সহিহ ইবনু হিব্বান : ২২১)।
বিভিন্ন জায়গায় শিশুদের মসজিদে যেতে নিষেধ করা হয়। অথচ এ ধরনের কাজ অনুচিত। আবু কাতাদা আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত; রাসূল (সা.) তার নাতনি উমামাকে কাঁধে নিয়ে নামাজ আদায় করতেন। উমামা হলো আবুল আসের ঔরসে রাসূল (সা.)-এর মেয়ে জয়নব (রা.)-এর সন্তান। রাসূল (সা.) সিজদায় যাওয়ার সময় উমামাকে নামিয়ে রাখতেন এবং উঠে দাঁড়ানোর সময় পুনরায় কাঁধে তুলে নিতেন (সহিহ বুখারি : ১/১০৯)। অন্য এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, আমি নামাজে দাঁড়ানোর পর তা দীর্ঘ করার ইচ্ছা করি। কিন্তু কোনো শিশুর কান্না শুনলে নামাজ সংক্ষেপ করে ফেলি এ ভয়ে যে, (মসজিদে আসা) শিশুটির মায়ের কষ্ট হতে পারে (সহিহ বুখারি : ১/১৪৩)।
মসজিদে নামাজে আসা শিশু যদি (নাবালিগ) একজন হয়, তাহলে তাকে বড়দের কাতারেই একসঙ্গে দাঁড় করানো যায়। এতে বড়দের নামাজের কোনো ক্ষতি হবে না। আর শিশু একাধিক হলে প্রাপ্তবয়স্কদের পেছনে আলাদা কাতারে তাদের দাঁড় করানো সুন্নাত। তবে হারিয়ে যাওয়া বা দুষ্টুমি করার আশঙ্কা থাকলে বড়দের কাতারেও দাঁড় করানো যাবে (আল-বাহরুর রায়িক : ১/৬১৮)। শিশুরা বড়দের কাতারে দাঁড়ালে কোনো অসুবিধা নেই। অনেকে মনে করেন নাবালিগ শিশুদের বড়দের কাতারে দাঁড় করালে পেছনের মুসল্লিদের নামাজ হয় না বা নামাজ ত্রুটিযুক্ত হয়। আসলে ব্যাপারটি তা নয়। যদিও জামাতের কাতারের সাধারণ নিয়ম ও সুন্নাত হলো প্রাপ্তবয়স্করা সামনে দাঁড়াবে আর অপ্রাপ্তবয়স্করা পেছনে; কিন্তু এর ব্যতিক্রম হলে নামাজ অশুদ্ধ হওয়ার কোনো কারণ ঘটে না। এ জন্য শিশু একা হলে বা পেছনে দুষ্টুমির আশঙ্কা থাকলে বড়দের কাতারেই দাঁড় করানো উত্তম। নামাজিদের সঙ্গে শিশু থাকা বিষয়ে একটি হাদিস বেশ প্রসিদ্ধ। তাতে বলা হয়েছে, একদিন নবিজি (সা.) সিজদায় থাকা অবস্থায় তাঁর নাতি হাসান ও হোসাইন এসে তাঁর পিঠে চড়ে বসে। তারা নিজ থেকে নেমে না যাওয়া পর্যন্ত নবিজি মাথা তোলেননি। ফলে দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত তিনি সিজদায় থাকেন। নামাজ শেষে তাঁর কাছে এত দীর্ঘ সিজদার কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি জবাবে বলেন, আমার নাতিরা আমার পিঠে চড়ে বসেছিল। আমি তাদের বিরক্ত করতে চাইনি (সুনানু নাসায়ি : ১১৪১)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, নামাজ শেষ করে তিনি নাতিদের কোলে তুলে নেন। আবু ইয়ালা মাওসিলির আজ-জাওয়ায়িদ গ্রন্থে আনাস (রা.) সূত্রে এ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। উপর্যুক্ত দুটি সূত্র থেকে একই ধরনের বর্ণনা সহিহ বুখারি ও মুসলিমে রয়েছে। মসজিদে শিশুদের সঙ্গে রাসূল (সা.)-এর আচরণ এমনই ছিল। তাই মমতা ও ভালোবাসার নবির আদর্শ সবার অনুসরণ করা উচিত।
আমাদের দেশে এক সময় সূর্য উঠত মক্তবগামী শিশুদের কলকাকলিতে মুখরিত দৃশ্যে। চারদিকে শোনা যেত শিশুদের সম্মিলিত সূরা পাঠধ্বনি। ৭১১ হিজরিতে মুহাম্মাদ ইবনু কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পরপরই ভারতবর্ষে সাবাহি মক্তব শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা হয়। সেই থেকে জনপ্রিয় এ শিক্ষাব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে চলে এলেও সম্প্রতি এমন দৃশ্য একটা চোখে পড়ে না। শহর-গ্রাম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মুসলিম শিশুদের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ধর্মীয় পাঠশালা ‘মসজিদভিত্তিক মক্তব’। ক্রমশ মানুষের শিক্ষাচিন্তায় পরিবর্তন ঘটেছে। মক্তবের স্থান নিয়েছে কিন্ডারগার্টেন, টিউশন প্রভৃতি। এটা খুবই হতাশাজনক ব্যাপার। মক্তব হারিয়ে যাওয়া মানে শিশুদের ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের বুনিয়াদি ও সহজতর পথটি বন্ধ হয়ে যাওয়া। তাই সুপরিকল্পিত পাঠক্রম ও পাঠদান পদ্ধতি প্রণয়ন করে মক্তবগুলো পুনরুজ্জীবিত করা এবং শিশুদের মক্তবমুখী করা সচেতন অভিভাবকদের দায়িত্ব। এ ব্যাপারে সম্মানিত ইমাম-মুয়াজ্জিন ও মসজিদ পরিচালনা কমিটিকে যৌথভাবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা দরকার। ইমানের প্রথম পাঠ শিশুরা গ্রহণ করুক তাদের নিকটস্থ ও নিরাপদ আশ্রয় সাবাহি মক্তবে। কারণ, শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। মক্তবগামী শিশুদের ইমানদীপ্ত হাতেই রচিত হোক আগামী প্রজন্মের আলোকিত পথ।
আপনার সন্তানসন্ততিদের শেখাতে হবে যে, মসজিদভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে নামাজের বাইরে প্রধান কাজ হচ্ছে তালিম তথা শিক্ষাকার্যক্রম চালু করা। নানা বিষয়ে শিশু, তরুণ, যুবক, বৃদ্ধদের নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ক্লাস হতে পারে। বয়স্কশিক্ষা : সূরা-কেরাত, মাসয়ালা-মাসাইল, হাদিসের দরস, কিতাবি তালিম এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া যায়। যেমন মসজিদে নববিতে ‘আসহাবে সুফ্ফার’ ক্লাস হতো এবং এখনো তা চলমান। তা ছাড়া নিরক্ষরতা দূরীকরণের উদ্দেশ্যে গণশিক্ষা পরিচালনায় মসজিদ আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। মসজিদকে কেন্দ্র করে মক্তব-মাদ্রাসা গড়ে তোলা যায়। ইসলামের সোনালি যুগে মসজিদকে কেন্দ্র করেই বড় বড় লাইব্রেরি এবং বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। মসজিদে জ্ঞানচর্চা প্রসঙ্গে মহানবি (সা.) বলেছেন, কোনো সম্প্রদায় যদি আল্লাহর ঘরে একত্র হয়ে কুরআন পাঠ করে ও নিজেরা পরস্পরকে শিক্ষা দেয়, তাহলে তাদের ওপর শান্তি অবতীর্ণ হয়। আল্লাহর রহমত তাদের ঢেকে ফেলে। ফেরেশতারা তাদের ঘিরে রাখে এবং মহান আল্লাহ তার ফেরেশতাদের কাছে তাদের কথা আলোচনা করেন (সহিহ মুসলিম : ২৬৯৯)।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক