মুসলিম জাগরণের পথিকৃৎ আল্লামা শামছুদ্দীন কাসেমী (রহ.)
মাওলানা বাহাউদ্দীন জাকারিয়া
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা শামছুদ্দীন কাসেমী (রহ.) বাংলাদেশের ইতিহাসে চির ভাস্বর একটি নাম। স্বাধীনতা সংগ্রামী, স্পষ্টভাষী, তেজস্বী, বাগ্মী। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ইসলামি জীবনব্যবস্থাকে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করতে তিনি ছিলেন উৎসর্গপ্রাণ।
এ দেশে ইসলামি শিক্ষার বিস্তার, নববি আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে তিনি চির অমর হয়ে আছেন। একজন প্রথিতযশা দূরদর্শী আলেমে দ্বীন হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন এ দেশে ইসলামি রাজনীতির অন্যতম দিকপাল।
ভ্রান্ত মতবাদ ও ইসলামবিরোধী সব অপশক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন চির আপসহীন বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব; সব অন্ধকারের বিপরীতে ছিলেন আপন কর্ম ও কীর্তিতে উজ্জ্বল এক মহান প্রদীপ।
মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমী ছিলেন রাজপথের মানুষ, ইসলামের সুরক্ষায় সব আন্দোলন-সংগ্রামে সর্বদাই থাকতেন নেতৃত্বে ও ফ্রন্টলাইনে। ১৯৩৫ সনে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণ করা মাওলানা কাসেমীর রক্তেই মিশে ছিল বাতিলবিরোধী আন্দোলন ও সংগ্রাম। কারণ তৎকালীন জমিদারদের অত্যাচার ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে ছিল তার পূর্বপুরুষদের জোরালো ভূমিকা ও অবদান। নেতৃত্বের গুণাবলি তিনি পেয়েছিলেন বংশপরম্পরায়।
সন্দ্বীপের হরিষপুর মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাস; অতঃপর চট্টগ্রামের জিরি মাদ্রাসা, ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ ও লাহোরের জামিয়া আশরাফিয়া থেকে শিক্ষাগ্রহণ শেষে ১৯৬১ সালে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সোহাগী মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসাবে তার কর্মজীবন শুরু হয়।
এরপর ঢাকার বড়কাটারা মাদ্রাসা, ফরিদাবাদ মাদ্রাসা ও যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসায় বহু বছর অধ্যাপনা শেষে ১৯৭০-এ থিতু হন ঢাকার তুরাগপাড়ের মিরপুরে। মিরপুরের হরিরামপুর এলাকায় তার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে দেশের শীর্ষস্থানীয় ইসলামি বিদ্যাপীঠ জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ মাদ্রাসা। আমৃত্যু তিনি আরজাবাদ মাদ্রাসার শাইখুল হাদিস ও মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ ও সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুরাগী পৃষ্ঠপোষক। তারই তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক জমিয়ত ও মাসিক পয়গামে হক। বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমে মাতৃভাষা বাংলা, ইতিহাস, সমাজ-ভূগোল, পৌরনীতি, গণিত ও ইংরেজির পাঠদান যুক্ত করা ছিল মাওলানা কাসেমীর যুগান্তকারী সংস্কারমূলক অবদান। তিনি তার প্রতিষ্ঠিত আরজাবাদ মাদ্রাসায় দশম শ্রেণি পর্যন্ত জেনারেল শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে দেন। অবশ্য এজন্য তাকে অনেক কটুকথাও শুনতে হয়েছে।
বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর সম্মিলিত প্লাটফর্ম ও কেন্দ্রীয় শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিস প্রতিষ্ঠায় ছিল তার বলিষ্ঠ ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশের বহু মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে গেলে এগুলো আবার খোলার পেছনে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আল্লামা কাসেমী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। তার প্রচেষ্টায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ২২ মার্চ রেজুলেশন করে স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি প্রকাশ্যে পাকবাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করেন ও পাকিস্তানের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কে পাকিস্তানি আর্মির জুলুমের প্রতিবাদে জনসভা ডেকে বক্তব্য রাখেন। এ কারণে পাক সেনারা তাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে রাখে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বে তিনি স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। আইয়ুব সরকারের আমলে স্বৈরাচারবিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শরিক থাকেন; সম্মিলিত বিরোধী দলের অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, নেজামে ইসলাম পার্টিসহ সব দলের নেতাদের সঙ্গেই তিনি বসেছেন। মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গেও তিনি নানা উপলক্ষ্যে বৈঠক করেছেন।
সব সময় তিনি ইসলামি জীবনব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য শাসকদের উৎসাহিত করেছেন; ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে কখনো চেষ্টা চালাননি।
১৯৬৬ সালে ঢাকায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পূর্ব পাকিস্তানের কমিটি গঠিত হলে তিনি এর সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে আবার সেক্রেটারি জেনারেল পদে নির্বাচিত হন এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন। পরে জমিয়তের সহ-সভাপতি ও নির্বাহী সভাপতি হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি হযরত হাফেজ্জী হুজুরের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। ৮১-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হাফেজ্জী হুজুরের তৃতীয় স্থান অধিকারের পেছনে মাওলানা কাসেমী ও জমিয়তের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি।
খেলাফত আন্দোলন গঠন, এর সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন, খেলাফত আন্দোলন থেকে নীতিগতভাবে সমর্থন প্রত্যাহার ও পরবর্তী সময়ে ইসলামী ঐক্যজোট গঠনে মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমীর ভূমিকা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
এ দেশে মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমীর নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় বাতিলবিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে চষে বেড়িয়েছেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবি, শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দি ও শাইখুল ইসলাম সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানির বিপ্লবী চিন্তাধারা নিয়ে। বিভিন্ন ভ্রান্ত মতবাদ ও ইসলামবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন একক নাম।
বিশেষ করে ইসলামের দুশমন, ভণ্ড নবি গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর অনুসারী আহমদীয়া মুসলিম জামাত নামধারীদের ধোঁকা ও অপতৎপরতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সোচ্চার। প্রতিষ্ঠা করেছেন খতমে নবুওয়ত আন্দোলন পরিষদ বাংলাদেশ, মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত নামে সংগঠন। তিনি ছিলেন স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশে খতমে নবুওয়তের মহান আকিদা সংরক্ষণ আন্দোলনের রূপকার ও বীর সেনানী।
যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ইসলামপ্রতিষ্ঠা ও আল্লাহর বাণী উচ্চকিত করতে কাজ করে গেছেন। বিন্দুমাত্র বাতিলের সঙ্গে আপস করেননি। নিজ চেতনা ও আদর্শে ছিলেন চির অটল, অবিচল। চিন্তা, স্বতন্ত্র চেতনার ভিন্নতা ও কর্মপদ্ধতির পার্থক্য সত্ত্বেও তিনি সব ঘরানার আলেমদের সঙ্গে উষ্ণ ভালোবাসা ও মর্যাদাকর সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। পদ্ধতিগত মতপার্থক্য কোনোদিন বিভেদের অলঙ্ঘনীয় প্রাচীর নির্মাণ করতে পারেনি।
‘শিয়া কাফের’, ‘কাদিয়ানী ধর্মমত’, ‘ইসলাম বনাম কমিউনিজম’, ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’সহ আরও বেশ কয়েকটি কালজয়ী গ্রন্থের রচয়িতা, বাতিলের সঙ্গে চির-আপসহীন ক্ষণজন্মা এ মহাপুরুষ ১৯৯৬ সালের ১৯ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন। এরই সঙ্গে বিপ্লবী মাদানি কাফেলার শেষ নক্ষত্রটি আমাদের চোখের আড়াল হয়। মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধসংলগ্ন কবরস্থানে এখন তিনি শুয়ে আছেন।
লেখক : প্রিন্সিপাল, জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ, মিরপুর, ঢাকা