সুস্বাস্থ্যের জন্য নবিজির খাদ্য নির্দেশনা
বিলাল হোসেন মাহিনী
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মুমিনের দিন-রাত আল্লাহর জন্য নিবেদিত হতে হবে। তার প্রতিটি মুহূর্ত অতিবাহিত হবে আল্লাহর স্মরণে এবং তার বিধান পালনের মাধ্যমে। তার সব কর্ম সম্পাদিত হতে হবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণ-অনুকরণের মধ্য দিয়ে।
প্রখ্যাত সুফি সাধক নিজামুদ্দীন আওলিয়া বলেন, ‘স্বল্প আহার, স্বল্প কথন, স্বল্প মেলামেশা, স্বল্প নিদ্রার মধ্যেই নিহিত আছে মানুষের পূর্ণতা।’ তবে খাবার হতে হবে সৎপথে অর্জিত ও পবিত্র। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের উপার্জিত পবিত্র বস্তু হতে আহার কর’ (সূরা আল-বাক্বারাহ, ২৬৭)।
নানা কারণে মানুষের মধ্যে রোগব্যাধি ও অসুস্থতা বাড়ছে। মানুষ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারাচ্ছে। ভেজাল ও অপবিত্র খাবার গ্রহণের মাধ্যমে রাড়ছে রোগ-ব্যাধি। ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, ব্লাড প্রেসার, শ্বাসকষ্ট, অনিদ্রা ইত্যাদি রোগ আধুনিক মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নতুন নতুন ভাইরাস ও অদ্ভুত রোগব্যাধি। এসব রোগ ও রোগীর কূল-কিনারা করতে না পেরে বর্তমানে ‘কম আহার করুন, বেশি দিন বাঁচুন’ এই স্লোগানের ওপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। আর মানুষকে বারবার স্মরণ করে দেওয়া হচ্ছে, বেশি খেলে বহু রোগ সৃষ্টি হয়।
প্রফেসর রিচার বার্ড এ মর্মে একটি তালিকাও প্রণয়ন করেছেন। তিনি লিখেছেন, বেশি খেলে কী কী ক্ষতি হতে পারে। যেমন : ১. মস্তিষ্কের ব্যাধি, ২. চক্ষু রোগ, ৩. জিহ্বা ও গলার রোগ, ৪. বক্ষ ও ফুসফুসের ব্যাধি, ৫. হৃদরোগ, ৬. যকৃৎ ও পিত্তের রোগ, ৭. ডায়াবেটিস, ৮. উচ্চরক্তচাপ, ৯. মস্তিষ্কের শিরা ফেটে যাওয়া, ১০. দুশ্চিন্তাগ্রস্ততা, ১১. অর্ধাঙ্গ রোগ, ১২. মনস্তাত্ত্বিক রোগ এবং ১৩. দেহের নিুাংশ অবশ হয়ে যাওয়া। (সান, উইকলি, সুইডেন)।
অথচ স্বল্প আহারের প্রতি জোর তাগিদ দিয়ে নবি (সা.) বলেছেন, ‘পেটের এক-তৃতীয়াংশ আহারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানির জন্য আর এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৩৪৯)। পেটের এক-তৃতীয়াংশ পানি দিয়ে পূর্ণ করতে বলার কারণ হলো, পানির মধ্যেও বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে। পানি খাদ্য হজম করতে সাহায্য করে।
এছাড়া পানির কাজ হলো-শরীরে রক্তের তরলতা বজায় রাখা, শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় দূষিত জিনিস নির্গত করতে সাহায্য করা, খাদ্যদ্রব্য হজম করতে সাহায্য করা, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, শরীরের অম্ল-ক্ষারের স্বাভাবিকতা ঠিক রাখা, হরমোন তৈরি করতে অনেক ক্ষেত্রে সাহায্য করা।
একজন ইমানদার শুধু নামাজ-রোজায়ই তার জীবনকে সীমাবদ্ধ রাখেন না। তার আহার, নিদ্রা-জাগরণ সব কিছুই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনাদর্শ মোতাবেক পরিচালিত হতে হবে। মুহাম্মাদ ইবনে বাশশার (রহ.) নাফে (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ইবনে ওমর (রা.) ততক্ষণ পর্যন্ত আহার করতেন না যতক্ষণ না তার সঙ্গে খাওয়ার জন্য একজন মিসকিনকে ডেকে আনা হতো। একবার আমি তার সঙ্গে বসে খাওয়ার জন্য এক ব্যক্তিকে নিয়ে এলাম। লোকটি খুব বেশি পরিমাণে আহার করল।
তিনি বলেন, নাফে! এমন মানুষকে আমার কাছে নিয়ে আসবে না। আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি, ‘মুমিন এক পেটে খায়। আর কাফির সাত পেটে খায়’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২০৬০)। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, মিকদাম ইবন মাদিকারাব (রা.) বলেন, আমি রাসূল (সা.)কে বলতে শুনেছি, পেটের চেয়ে মন্দ কোনো পাত্র মানুষ ভরাট করে না। পিঠের দাঁড়া সোজা রাখার মতো কয়েক লোকমা খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। আর বেশি খাবার ছাড়া যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাবারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানির জন্য আর বাকি এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে (তিরমিজি, হাদিস : ২৩৮৩)।
রাতের খাবার খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়া স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লে পাকস্থলী শয়ন অবস্থায়ও কর্মরত থাকে। ফলে পরিপাকের ত্রুটিসহ বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি হতে পারে। তাই এশার নামাজের আগে রাতের খাবার খেয়ে নিলে একদিকে মসজিদে যাওয়া-আসা, নামাজ আদায় ইত্যাদির মাধ্যমে ঘুমানোর আগেই পাকস্থলীর কাজ প্রায় শেষ হয়ে যায়, অন্যদিকে এশার নামাজের পর তাড়াতাড়ি ঘুমানো সম্ভব হয়, যা সুস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি।
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) এশার নামাজের আগে ঘুমাননি এবং তারপর নৈশ আলাপ করেননি (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৭০২)। রাসূল (সা.) কিছু খাবার পছন্দ করতেন। সেগুলো সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। এসব খাবারের গুণাগুণ এবং মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি আধুনিক গবেষণায়ও প্রমাণিত। যেমন : খেজুর, দুধ, মধু, জবের রুটি, লাউ, গোশত, পনির, মাখন, মিঠাই ইত্যাদি। প্রয়োজন ও পরিমাণমতো এসব খাবার গ্রহণ করা যেতে পারে।
বর্তমানে মিক্সড ফুড, পাঁচমেশালি সবজির প্রতি জোর দেওয়া হয়। বিশেষভাবে সকালের নাশতায় পাঁচমেশালি সবজি রাখার তাগিদ দেওয়া হয়। এ ধরনের খাবারের পুষ্টিগুণই শুধু বেশি নয়, বরং স্বাদেও অসাধারণ। এ বিষয়ে একটি হাদিস স্মরণীয়। সালামাহ (রহ.) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে এক যুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমাদের মধ্যে খাদ্যের অভাব দেখা দিল। অবশেষে আমাদের কিছু সওয়ারির বাহন জবাই করার কথা ইচ্ছা করেছিলাম। তখন নবি করিম (সা.)-এর নির্দেশে আমরা আমাদের খাদ্যদ্রব্য একত্রিত করলাম। আমরা একটি চামড়া বিছালাম এবং তাতে লোকদের খাদ্যদ্রব্য জমা করা হলো।
বর্ণনাকারী বলেন, আমি সেটির প্রশস্ততা অনুমান করার জন্য দাঁড়ালাম এবং আমি আন্দাজ করলাম সেটি একটি ছাগল বসার স্থানের সমান। আর আমরা সংখ্যায় ছিলাম ১৪০০। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা সবাই তৃপ্তির সঙ্গে খেলাম। তারপর আমাদের নিজ নিজ খাদ্য রাখার থলে পূর্ণ করে নিলাম... (মুসলিম, হাদিস : ৪৩৬৯)। এ হাদিসের ভাষ্য মতে, পাঁচমেশালি অল্প খাবার বহু মানুষের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়।
খাবার গ্রহণের কতিপয় সুন্নাত
মুত্তাফাকুন আলাইহি (বুখারি-মুসলিম)সহ সহিহ হাদিসের ভাষ্যে আহারের আগের বিসমিল্লাহ বলা এবং ডান হাত দিয়ে আহার করা সুন্নাত। আরও সুন্নাত হলো-সঙ্গীর পক্ষ থেকে কোনো অসন্তুষ্টির নিদর্শন না দেখলে পাত্রের সবদিক থেকে খুঁজে খুঁজে খাওয়া। আহার ও অন্য কাজ ডান দিক থেকে শুরু করা। পরিতৃপ্ত হওয়া পর্যন্ত আহার করা। নরম রুটি খাওয়া এবং দস্তরখানে খাওয়া। একজনের খাবার দুজনের জন্য যথেষ্ট হয়।
লেখক : প্রভাষক, গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদ্রাসা, যশোর