শিল্প সাহিত্য চর্চায় সাহাবায়ে কেরাম
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাসূল (সা.)-এর খাদেম প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আনাস ইবন মালিক (রা.) বলেন, যখন রাসূল (সা.) আমাদের এখানে (মদিনা) আসেন তখন আনসারদের প্রতিটি গৃহে কবিতা বলা হতো।
ইসলামি যুগে দাওয়াতি কাজের জন্য, ব্যক্তি-সাহসকে জাগিয়ে তোলার জন্য, বিভিন্ন দল ও মতের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য এবং শত্রুকে ভয় দেখানো ও বিতাড়নের জন্য খুতবার বেশি প্রয়োজন হওয়ায় সাহিত্যের মর্যাদা বেড়ে যায় [আল-বায়ান ওয়াত তাবয়ীন, ২/৯৮]।
ইসলামি যুগে শিক্ষার প্রসার হওয়ার এবং প্রয়োজনের তাগিদে পত্র-সাহিত্যের চর্চা শুরু হয়। এ পত্র-সাহিত্যের সূচনা করেন রাসূল (সা.)। পরবর্তীকালে খলিফারা, প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সেনাবাহিনীর কমান্ডাররা নানা ধরনের পত্রের আদান-প্রদান করেছেন, এসব পত্রেরও একটা সাহিত্য মান ও মূল্য আছে।
একদা শারিদ ছাকাফি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বাহনের পেছনে আরোহী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তার কাছে উমিয়্যার কবিতা শুনতে চাইলেন। তিনি আবৃত্তি করছিলেন, আর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে আরও শোনাতে বলছিলেন। তিনি সেদিন মোট একশটি শ্লোক শুনেছিলেন।
মদিনায় হিজরাত পরে কাফেররা কবিতার দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সা.), আনসার ও মুহাজিরদের গোত্র, ব্যক্তি চরিত্র ও ইসলামের নিন্দা ও কুৎসা বর্ণনা করতে থাকে। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনার আনসারদের লক্ষ্য করে বলেন, যারা হাতিয়ার দ্বারা আল্লাহ ও তার রাসূলকে সাহায্য করছে, জিহবা দ্বারা সাহায্য করতে কে তাদের বাধা দিয়েছে? এ কথা শুনে হাসসান ইবনে ছাবিত বলেন, আমি এর জন্য প্রস্তুত।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমিও তো কুরাইশ বংশের। তুমি কীভাবে তাদের নিন্দা করবে? উত্তরে তিনি বলেন, মথিত আটা থেকে চুল যেভাবে বের করে আনা হয় আমিও তদ্রুপ আপনাকে বের করে আনব। তার জন্য মসজিদে নববিতে একটি মিম্বর স্থাপন করা হয়। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে স্বরচিত কবিতা আবৃতি করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তার কবিতা শুনে বলতেন, ‘আমার পক্ষ থেকে জবাব দাও। হে আল্লাহ রুহুল কুদ্দুসকে দিয়ে তার সাহায্য কর।’
আর রাসূল (সা.) তাকে এ কথাও বলেন যে, তুমি আবু বকরের কাছে গিয়ে কুরাইশদের দোষ-ত্রুটি ও দুর্বল দিকগুলো জেনে নাও। এ সম্পর্কে আবু বকরই অধিক জ্ঞানী। সত্যিই সেদিন হাসসান এ কাজের উপযুক্ত ছিলেন এবং অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এ ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছিলেন।
তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, তার এ কবিতা তাদের জন্য তীরের আঘাতের চেয়েও তীব্রতর। এসব কারণেই তিনি সঙ্গতভাবেই ‘শাইরুর রাসূল’ বা রাসূলের কবি নামে খ্যাতি লাভ করেছেন। এ কবিতার সংঘর্ষে অপর যে দুজন কবি তাকে সাহায্য করেন তারা হলেন, কাব ইবন মালিক ও আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা। সিরাতে ইবনে হিশাম পাঠ করলে কবিতার ও লড়াইয়ের একটা চিত্র দেখতে পাওয়া যায়।
ইসলামি সাহিত্যের ইতিহাসে কবি কাব ইবন যুহায়রের ঘটনাটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইসলাম শিল্প ও সাহিত্যের প্রতি যে কত উদার ও এর কত বড় পৃষ্ঠপোষক-এ ঘটনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। জাহেলি ও ইসলামি যুগের বিশিষ্ট কবি কাব ইবন যুহায়র। তিনি ইসলাম গ্রহণের আগে ইসলাম ও ইসলামের নবির নিন্দামূলক কবিতা রচনা করে রাসূলের বিরাগভাজন হন। রাসূল (সা.) তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। সে ব্যক্তিই যখন ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় এলেন এবং তার বিখ্যাত কাসিদা ‘বানত ‘বানত সূ’আদ’ আবৃত্তি করে রাসূল (সা.)কে শোনান, তখন রাসূল (সা.) তাকে শুধু ক্ষমাই করেননি; বরং খুশির আতিশয্যে তার সৃষ্টির প্রতিদান স্বরূপ নিজ দেহের চাদরটি তাকে উপহার দেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর তার সুযোগ্য খলিফারা ইসলামি রাষ্ট্রের পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। এ যুগেও কবিতাচর্চায় তেমন ভাটা পড়েনি। খোলাফায়ে রাশিদিন সর্বদাই কবিতা আবৃত্তি করতেন। আর রাসূলুল্লাহর (সা.) সাহাবিরা তো মসজিদে নববিতে কবিতা আবৃত্তির আসর বসাতেন [ড. শাওকি দায়ফ, তারিখ আল-আদাব, ২/৪৫]।
সাঈদ ইবন আল-মুসায়্যিব বলেন, আবু বকর (রা.) কবি ছিলেন। উমর (রা.) কবি ছিলেন। আর আলী (রা.) ছিলেন তিনজনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি [ইবন আবদি বাব্বিহি, আল-ইকদ আল-ফারিদ, ৫/২৮৩]।
উমর (রা.) কুরআনের আয়াতের অর্থ বুঝতে কবিতার শরণাপন্ন হতেন। একবার তিনি মিম্বরে ওপর দাঁড়িয়ে সূরা আন-নাহলের ৪৭তম আয়াত পাঠ করেন। তারপর উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামের কাছে আয়াতে উল্লিখিত তাকাউয়ুফিন শব্দটির অর্থ জানতে চান। সাহাবায়ে কেরাম সবাই চুপ থাকলেন। তখন হুযায়ন গোত্রের এক বৃদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হে আমিরুল মুমিনিন! এটা আমাদের উপভাষা। এর অর্থ অল্প-অল্প নেওয়া।
উমর (রা.) বৃদ্ধের কাছে জানতে চাইলেন, আরবরা কি তাদের কবিতা থেকে অর্থ জানতে পারে? অর্থাৎ আরব কবিরা তাদের কবিতায় এ অর্থে শব্দটি প্রয়োগ করেছেন? বৃদ্ধ বললেন, হ্যাঁ আমাদের কবি আবু কাবির আল-হুযালী তার উষ্ট্রীর বর্ণনা দিতে গিয়ে একটি শ্লোকে এ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তারপর বৃদ্ধ শ্লোকটি আবৃত্তি করে শোনান। উমর (রা.) তখন বলেন, তোমরা তোমাদের দিওয়ান সংরক্ষণ করে রাখ, তাহলে তোমরা আর গোমরাহ্ হবে না [ইবন মানসুর, লিসান আ-আরাব-২/১৯৯২]।
আলী (রা.) ছিলেন জ্ঞানের ভান্ডার। সে যুগের আরব কবিদের মধ্যে তিনিও একজন শ্রেষ্ঠ কবি। ‘দিওয়ানে আলী, নামক কাব্য সংকলন গ্রন্থটি আজও তার কাব্য প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।
আয়েশা (রা.) বলেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের কবিতা শিক্ষা দেবে। এতে তাদের ভাষার আড়ষ্টতা দূর হয়ে সহজ সাবলীল হবে [আল-ইকদ আল-ফারিদ, ৫/২৭৪. ৬/৭]। এভাবে যদি সে যুগের আরবি সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে সাহিত্যে চর্চার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরাম ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। মূলত সাহাবায়ে কেরামের দুই আদর্শ ছিল আল কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (সা.) সুন্নাহ।
লেখক : গবেষক, কলামিস্ট