Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

আল্লাহর সিংহাসন আরশে আজিম

Icon

মো. আবদুল গনী শিব্বীর

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আল্লাহর সিংহাসন আরশে আজিম

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জগৎগুলোর সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিজিকদাতা। তিনি তার একান্ত পরিকল্পনা ও অনুগ্রহে জগতের সব কিছুই সৃষ্টি করেন। স্বীয় পরিকল্পনায় সাজিয়েছেন জগতের সব কিছু। তিনি এতই ক্ষমতাবান যে, কোনো কিছু সৃষ্টির নিমিত্তে তার ইচ্ছাই যথেষ্ট; যখনই তিনি সৃষ্টি করতে চান তখন শুধু ‘কুন’ বা ‘হও’ নামক শব্দের উচ্চারণ করেন তখন তা তৎক্ষণাতই হয়ে যায়। পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ বলেন, ‘তার ব্যাপার তো এই যে, তিনি যখন কোনো কিছু করতে ইচ্ছা করেন, তখন তিনি কেবল বলেন, ‘হও’; ফলে তা হয়ে যায়।’ (সূরা ইয়াসিন : আয়াত : ৮২)। কি অসীম ক্ষমতা! অতুলনীয় তার বাহাদুরি, কত সুন্দর সৃষ্টির কারিশমা, কি দারুণ সৃষ্টির রূপায়ণ। এ সবই মহান জাতেপাক আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। ক্ষমতাধর এ মহান প্রভুর ক্ষমতার মসনদ হলো ‘আরশে আজিম’।

আরশে আজিম মহান আল্লাহপাকের অতুলনীয় অকল্পনীয় এক কুদরত। এটি মাখলুকাতের সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুকও বটে। পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে আল্লাহপাক আরশ সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন এ মর্মে, ‘তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ যিনি ছয় দিনে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর ‘আরশে’ সমুন্নত হয়েছেন। দিনকে তিনি রাতের পর্দা দিয়ে ঢেকে দেন, তারা একে অন্যকে দ্রুতগতিতে অনুসরণ করে এবং সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি তারই আজ্ঞাবহ। জেনে রেখ, সৃষ্টি তার, হুকুমও (চলবে) তার, বরকতময় আল্লাহ বিশ্বজগতের প্রতিপালক। (সূরা আল আরাফ : আয়াত : ৫৪)। তিনি আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক হলেন আল্লাহ, যিনি আকাশমণ্ডলী আর পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নত হয়েছেন। তিনি যাবতীয় বিষয়াদি পরিচালনা করেন। তার অনুমতি প্রাপ্তি ছাড়া সুপারিশ করার কেউ নেই। তিনিই হলেন আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। কাজেই তোমরা তারই ইবাদাত কর, তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না? (সূরা ইউনুস : আয়াত : ০৩)। তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহই স্তম্ভ ছাড়াই আকাশমণ্ডলীকে ঊর্ধ্বে তুলে রেখেছেন, যা তোমরা দেখছ, অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নত হয়েছেন তিনিই সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়মের বন্ধনে বশীভূত রেখেছেন, প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গতিশীল আছে। যাবতীয় বিষয় তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন, তিনি নিদর্শনগুলো বিশদভাবে বর্ণনা করেন যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাসী হতে পার। (সূরা আর রাদ : আয়াত : ০২)। উপরোক্ত আয়াতগুলো পর্যালোচনা করলে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অসীম ক্ষমতা ও ক্ষমতার মসনদ আরশের সুস্পষ্ট বর্ণনা প্রতিভাত হয়।

আরশ মহান জাতেপাকের মসনদ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘দয়াময় আরশে সমাসীন।’ (সূরা ত্বহা : আয়াত : ০৫)। সৃষ্টি জগতের সর্বোচ্চ মর্যাদাকর স্থানে তিনি আরশকে স্থাপন করেছেন। আরশের নিচে জান্নাত বিদ্যমান আর তার বরাবর নিচে ফেরেশতাদের ইবাদত তথা তাওয়াফের জন্য নির্মিত ‘বায়তুল মামুর’ নামক স্থান। নিষ্পাপ নিষ্কলুষ ফেরেশতাদের একমাত্র তাওয়াফভূমি বায়তুর মামুরের ঠিক নিচ বরাবর ‘কাবাতুল মুশাররাফা’ অবস্থিত। হাদিসে রাসূলে আরশের অবস্থান সম্পর্কে সুন্দর ও সুস্পষ্ট বর্ণনা এভাবে এসেছে, হজরত আবু হুরাইরা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, নবি (সা.) বলেন, অবশ্যই জান্নাতে ১০০টি দরজা (মর্যাদা) রয়েছে, যা আল্লাহ তার পথে জিহাদকারীদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন; দুটি দরজার মধ্যবর্তী ব্যবধান আসমান ও জমিনের মতো। সুতরাং তোমরা যখন আল্লাহর কাছে জান্নাত চাও তখন জান্নাতুল ফিরদাউস চাইবে। কারণ তা হলো জান্নাতের মধ্যভাগ ও জান্নাতের উপরিভাগ। তার ওপরে রয়েছে রহমানের আরশ, আর সেখান থেকেই প্রবাহিত হয় জান্নাতের নদীমালা। (সহিহ আল বুখারি : হাদিস : ২৭৯০)।

আরশে আজিম বহন করার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন একদল ফেরেশতা নিয়োজিত করে রেখেছেন। তিনি তাদের আরশ বহন করার উপযোগী ধৈর্য শক্তি সামর্থ্য, যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়ে বিশেষভাবে সৃষ্টি করেছেন। তাদের প্রকৃত আকৃতি প্রকৃতি ও সংখ্যা কত? তা কেবল তিনিই জানেন। আল্লাহপাক এসব ফেরেশতাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তারা তাদের অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে তামিল করে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজিদে বর্ণিত হয়েছে, ‘যারা আরশ বহন করে এবং যারা তার চারপাশে আছে, তারা তাদের পালনকর্তার সপ্রশংস পবিত্রতা বর্ণনা করে, তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের পালনকর্তা, আপনার রহমত ও জ্ঞান সব কিছুতে পরিব্যাপ্ত। অতএব, যারা তওবা করে এবং আপনার পথে চলে, তাদের ক্ষমা করুন এবং জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করুন। (সূরা গাফের : আয়াত : ০৭)। মহাপ্রলয়ের দিনে পৃথিবীর সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। ‘ভূপৃষ্ঠের সব কিছুই ধ্বংসশীল। একমাত্র আপনার মহিমায় ও মহানুভব পালনকর্তার সত্তা ছাড়া।’ (সূরা আর রহমান : আয়াত : ২৬)। মহাপ্রলয় তথা কিয়ামতের মুহূর্তে আল্লাহর আরশকে এমন আটজন ফেরেশতা বহন করবেন যাদের প্রকৃত আকৃতি শক্তি সামর্থ্য আল্লাহই জানেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘ফেরেশতারা আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে ও আটজন ফেরেশতা আপনার পালনকর্তার আরশকে তাদের ঊর্ধ্বে বহন করবে। (সূরা আল হাককাহ : আয়াত : ১৭)। আরশের মাঝে রয়েছে আল্লাহপাকের মসনদ তথা কুরসি। কুরসি আরশের চেয়ে তুলনামূলক ছোট। এ কুরসিতে আল্লাহপাক উপবিষ্ট হন। তার কুরসির পরিসীমা কুরআনে মাজিদে এ মর্মে বর্ণিত রয়েছে, ‘তার সিংহাসন সব আসমান ও জমিনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তার পক্ষে কঠিন নয়। তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান। (সূরা বাকারা : আয়াত : ২৫৫)।

পৃথিবীতে সূর্য প্রতিনিয়ত উদিত ও অস্তগামী হয়। প্রতিদিনকার সূর্যটি আরশে আজিমের নিচে পৌঁছে মহান আল্লাহপাকের প্রতি সিজদা করে। সূর্যের সিজদার স্থান আরশের নিচে। এ বিষয়ে হাদিসের সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে, আবু যার (রা.) হতে বর্ণিত, নবি (সা.) সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় আবু যার (রা.) কে বললেন, তুমি কি জান, সূর্য কোথায় যায়? আমি বললাম, আল্লাহ এবং তার রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, তা যেতে যেতে আরশের নিচে গিয়ে সিজদায় পড়ে যায়। অতঃপর সে আবার উদিত হওয়ার অনুমতি চায় এবং তাকে অনুমতি দেওয়া হয়। আর শিগ্গির এমন সময় আসবে যে, সিজদা করবে কিন্তু তা কবুল করা হবে না এবং সে অনুমতি চাইবে কিন্তু তাকে অনুমতি দেওয়া হবে না। তাকে বলা হবে, যে পথ দিয়ে এলে ওই পথেই ফিরে যাও। তখন সে পশ্চিম দিক হতে উদিত হয় এটাই মর্ম হলো মহান আল্লাহর বাণীর : ‘আর সূর্য নিজ গন্তব্যে (অথবা) কক্ষ পথে চলতে থাকে। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। (ইয়াসিন ৩৮)।’ (সহিহুল বুখারি : হাদিস : ৪৮০৩)।

আরশে আজিম অতি মূল্যবান স্থান। যে স্থান কেবল আল্লাহর জন্যই। মুহাক্কিক ওলামাগণ বলেন, আরশ হলো সৃষ্টিজগতের ছাদস্বরূপ। আরশের নিচেই সবকিছু; কেবল আল্লাহপাকই আরশের ওপরে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। মহাক্ষমতাধর ও প্রতাপশালী আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের আরশের ছায়ার নিচে তার কিছু প্রিয় বান্দাহ কিয়ামতের দিন সাময়িক অবস্থানের সুযোগ পাবে। তারা কারা? তাদের পরিচয় স্পষ্ট করে দিয়েছে বিশ্বনবি (সা.) মুখ নিঃসৃত বাণী, আবু হুরাইরা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে তার (আরশের) ছায়া দান করবেন যেদিন তার ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না; (তারা হলো,) ১. ন্যায় পরায়ণ বাদশাহ (রাষ্ট্রনেতা), ২. সেই যুবক যার যৌবন আল্লাহতায়ালার ইবাদতে অতিবাহিত হয়, ৩. সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদগুলোর সঙ্গে লটকে থাকে (মসজিদের প্রতি তার মন সদা আকৃষ্ট থাকে।) ৪. সেই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্থাপন করে; যারা এ ভালোবাসার ওপর মিলিত হয় এবং এ ভালোবাসার ওপরেই চিরবিচ্ছিন্ন (তাদের মৃত্যু) হয়। ৫. সেই ব্যক্তি যাকে কোনো কুলকামিনী সুন্দরী (ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে) আহ্বান করে, কিন্তু সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি।’ ৬. সেই ব্যক্তি যে দান করে গোপন করে; এমনকি তার ডান হাত যা প্রদান করে, তা তার বাম হাত পর্যন্তও জানতে পারে না। ৭. আর সেই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার উভয় চোখে পানি বয়ে যায়।’ (সহিহুল বুখারি : ৬৮০৬, সহিহ মুসলিম : ১০৩১)।

পরিশেষে মহান আল্লাহপাক আমাদের তার প্রিয় বান্দাদের মধ্যে শামিল করে কিয়ামতের দিনে আরশের সুশীতল ছায়ায় অবস্থান করার সৌভাগ্য লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদ্রাসা, সোনাপুর, সদর, নোয়াখালী

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম