পাঠক রস
যথা আজ্ঞা জাহাঁপনা
শেখ মোহাম্মাদ আলী
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বড় ভাইয়ের বৌভাত অনুষ্ঠানের আপ্যায়নের দায়িত্বে আছেন ছোট কাকা। এক সময় তিনি যাত্রাপালায় অভিনয় করতেন। সে ভাব ধারা এখনো বজায় আছে। মাঝে মধ্যে তা প্রয়োগ করে আমাদের মাতিয়ে রাখেন। আমি তার সব কাজের একান্ত সহযোগী হয়ে পাশে পাশে থাকি।
বৌভাতের আনুষ্ঠানিকতা শেষ। ক্লান্ত শরীরে বসে আছি। ছোট কাকা নীলাভ পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পরে রাজকীয় ভঙ্গিতে পায়চারি করছেন। চোখে মুখে তার বিরক্তির ভাব। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন।
‘দেখ তো, চা দিতে এত দেরি হচ্ছে কেন?’ এমন সময় কাকিমা, চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে চায়ের কাপ হাতে উপস্থিত হন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাকা বলল।
‘এক কাপ চা তৈরিতে এত সময় লাগে!’
খোঁচা দেওয়া কথায় রাগে গজরাতে থাকেন কাকি। শুরু হয় খই ফোটার মতো উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়। তা দেখে, কাজিন রাহনুমা বিনীত কণ্ঠে বলল।
‘বাবা, চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
প্রতি উত্তরে কাকা, আবেগ তাড়িত হয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে কাব্যিক ভাষায় বলতে থাকেন।
‘মামণি আমার। কী দুর্ভাগ্য আমার! চায়ের স্বাদে হিমেল ছোঁয়ায়, ভরে যায় এ মন!’
‘ঢং কইরো না!’
বিরক্তি সূচক মন্তব্য করে কয়েক কদম অগ্রসর হতেই, বজ কণ্ঠে গর্জে ওঠেন কাকা।
‘খামোশ! রাজ দরবার ত্যাগ করবার পূর্বে রাজার অনুমতি নিতে হয়! সে কথা কি ভুলে গেছ বেগম! মনে রেখ, তোমার এ ধৃষ্টতা ক্ষমার অযোগ্য!’
চোখে মুখে কালবৈশাখী ঝড়ের শোভা শোভিত হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় কাকিমা। বিচক্ষণ কাকা, কাকিমাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, আমার প্রতি তেজস্বী কণ্ঠের প্রকাশ ঘটান।
‘উজিরে আজম।’
ভক্তিতে গদগদ হয়ে বললাম।
‘জাহাঁপনা।’
কাকার আদেশ প্রদানের পূর্বেই কাজিন রেহনুমার আবেগীয় আবদার।
‘বাবা, আমারে হাজারখানেক টাকা দেও।’
‘না-না-না। টাকা বলে কোনো শব্দ আমি কখনো শুনিনি। উজিরে আজম, তুমি কি নতুন এ শব্দের অর্থ জানো?’
‘জি, জাহাঁপনা। আমাদের ভাষায় টংকা। তাদের ভাষায় টাকা।’
ছোট কাকা তখন রাশভারী বাবার দিকে তাকিয়ে, ভিক্ষারির মতো করুণ কণ্ঠে দুহাত প্রসারিত করে বলেন।
‘মহারাজ, আমার টংকার প্রয়োজন।’
কপাল কুঁচকে পাঞ্জাবির পকেটে হাতিয়ে বাবা, একটা খণ্ডিত টাকার বান্ডিল বের করে, কাকার হাতে দিলেন। টাকাটা হাতে নিয়ে কাকা, ডান হাতের দুই আঙুলে ঝুলিয়ে ধরে, নাড়াতে থাকেন। অগণিত হাজার টাকার নোট। সবার দৃষ্টি টাকার দিকে। গলার স্বর চড়িয়ে কাকা বলল।
‘উজিরে আজম, এ টাকা তোমার হেফাজতে রক্ষিত হোক।’
‘বাবা, ওর মারিং কাটিংয়ের অভ্যাস আছে।’
‘খামোশ কন্যা! উজিরে আজমকে আমি চিনি। সে সজ্জন, অমায়িক, দায়িত্ব পালনে অবিচল। এ রকম উজিরে আজম, ‘জামাই’ হওয়ার যোগ্য।’
কালক্ষেপণ করার মতো বোকা আমি নই।
আবেগে মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কাকার কথার প্রতি শতভাগ সম্মান দেখিয়ে, মাথা নুইয়ে কুর্নিশ জানিয়ে বললাম।
‘যথা আজ্ঞা জাহাঁপনা। আপনার আদেশ শিরোধার্য।’
মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি, হাসি দমিয়ে রাখতে চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছেন, বাবা। মা চাচিরা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে হাসছেন। বেফাঁস মন্তব্য করে কাকিমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, কাকা। রেহনুমার রাগত মুখের চাহনিতে মজা পেয়ে আমি, বোকার মতো হাসতে থাকি।
বেফাঁস মন্তব্যের কল্যাণে, মাঝে মাঝে এক অবস্থা থেকে
আরেক অবস্থায় উপনীত হতে-মন্দ লাগে না।
গফরগাঁও, ময়মনসিংহ