Logo
Logo
×

বিচ্ছু

রম্যগল্প

সংসার রণাঙ্গনের আহত নাবিক

Icon

শফিক হাসান

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অফলাইন বিষয়টা মন্দ ছিল না, বঙ্গবাজার, পল্টন থেকে, হোপ মার্কেটের ফুটপাত থেকে দর কষাকষি করে পোশাকাদি কিনতাম। ফুটো পকেটেও এসব কেনাকাটা চালান যেত। আর এখন! কোনো এক অদূরদর্শী আবিষ্কার করল অনলাইন; ওখানেই সীমাবদ্ধ থাকলে মন্দ হতো না। কিন্তু সেখানে কেনাকাটা শুরু হওয়ার পর থেকে আমার মতো প্রাণীদের বারটা বাজল। ই-কর্মাসের ‘ই’-র শেষ প্রান্ত বড় হতে হতে সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরছে গলায়।

গত পক্ষে কেনা পোশাকে হলুদ-মরিচের রং লাগার আগেই কুসুম আরেকটা অর্ডার করল অনলাইনে। অন্যায়ভাবে কেনা ফাইভ পিস পরে বউ আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, ‘আমাকে কেমন লাগছে গো?’

কষ্ট লুকিয়ে বললাম, ‘আগে আয়নায় দেখি নিজেকে কেমন লাগছে। চুল ক’গাছা বাকি আছে!’

‘তোমার চুলে ম্যাজিক শ্যাম্পু লাগিয়ে দেব। নতুন চর, আবার চুলে টইটম্বুর হয়ে উঠবে!’

এবার আদর্শ স্বামী হিসাবে কিঞ্চিত অভিনয় করতেই হয়, ‘তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। বয়স তেইশ বছর কমে গেছে!’

‘তেইশ বছর কমলে আমি তো শিশু-বাচ্চা! বয়স কত তাহলে?’

‘সরি। বিশ বছর কমেছে। মানে তোমার এখন কিশোরীকাল!’

কিশোরী হয়ে উঠতে পারায় খুশি হয় কুসুম। এবার আমার পছন্দের কফি বানিয়ে দিতে চায়। বানান কথার এত শক্তি! সম্মতি দিয়ে বিপদেই পড়লাম। রান্নাঘর থেকে ফিরে কুসুম বলে, ‘চিনি শেষ, দোকানে যাও। মিষ্টিহীন কফি খেতে ভালো লাগে না।’

‘চিনির কেজি এখন দেড়শত টাকা।’

‘বাজে বকো কেন? কেজি বারোশ টাকা হলেও আমার আপত্তি নেই!’

বাধ্য হয়েই বের হই। চিনি না কিনলে স্বস্তিতে থাকতে দেবে না। জীবন ভাজা ভাজা করে ফেলেছে কুসুম। মেজাজ তেতো হয়ে থাকে প্রায়ই। সেসব নিয়ে কুসুমের ভ্রূক্ষেপ নেই। কফির মিষ্টতা নিয়েই চিন্তিত। তবু ভালো, কিছু একটা পেলাম। অন্যদিন লবণ-চা চাইলেও ঝামটা দিয়ে বলত-‘নিজে বানিয়ে খাও’। এখন গরম কফির ছ্যাঁকা মুখে লাগান যাবে।

দোকানদারের সামনে অপ্রত্যাশিত খদ্দেরের ভিড় নেই। তাই বোধকরি হাসিমুখে বলল, ‘ভাইজান, কেমন আছেন?’

‘আছি লবণের মতো। এখন চিনি লাগবে।’

‘গুড়-চিনি সবই পাবেন। এখন চা খান।’

হাঁক দিয়ে সে সামনের চা দোকানে দুইটা চায়ের অর্ডার দেয়। ভেতরে ভেতরে খুশিই হলাম। এলাকায় নতুন এসেছি। ঘনিষ্ঠতা থাকলে তবু অসময়ে বাকি চাওয়া যাবে। চায়ে চুমুক দিয়ে দোকানদার কথার দোকান খুলে বসে। আলাপে-বিলাপে জানা যায়, দেলোয়ার আমার এলাকাতো ভাই। সেও নাকি কোনো একসময়ে বড়বাড়িতে কুসুমকে দেখতে গিয়েছিল। সরকারি চাকরি নেই, ঘুস না মেলার আভাস পেয়ে কুসুমের নানা প্রথম দেখাতেই অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। উলটো প্রশ্ন করেছিলেন, ‘মাসে কয়দিন আমার নাতনিকে মাছ-মাংস খাওয়াতে পারবে?’

দেলোয়ার পাকা ব্যবসায়ী, দমে যাওয়ার লোক নয়। বলেছিল, ‘খানাপিনা এখন ফকির-মিসকিনেও খায়। কিন্তু আপনাকে আমি ইশতেহার দেব না। হাট-বাজারের দোকানে গিয়ে সমাধা করেন।’

গল্পে মশগুল থাকায় দেলোয়ার বুঝতে পারে না, আমার দীর্ঘশ্বাসের একাংশ নাক হয়ে আছড়ে পড়ে চায়ের কাপে। কাঁপন ওঠে চা-সমুদ্রে। বুকে তখন অন্য কম্পন। বেছে বেছে ছোট সম্বন্ধগুলোই কেন আমার সামনে আসে! অথচ কুসুম সুযোগ পেলে কত রাঘব-বোয়াল পাত্রের গল্পই-না শোনায়। ভালো সম্বন্ধগুলো কোথায় লুকিয়ে থাকে!

চিনি নিতে এগিয়ে আসে শ্যালিকা। আমাকে সারপ্রাইজ দেবে বলেই নাকি আগমন-সংবাদ জানায়নি! মুখে হাসি ফোটালেও মনে প্রমদ গুনলাম-এবার অন-অফ সব লাইনেই হাঁটতে হবে। চলতি মাসে কার কাছে ধার পাওয়া যাবে! কুসুম জোহরাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘দুলাভাইয়ের সঙ্গে গল্প কর। আমি বেশি দুধ-চিনি দিয়ে কফি বানাচ্ছি।’

শ্যালিকাকে দেখে কী খুশিই না হলো কুসুম। অথচ যদি আমার কোনো ভাই-বোন আসত, মুখের দিকেই তাকান যেত না। মেঘ-লেপা থাকত।

গল্প করে বলি, ‘তোমার বাবা-মা কেমন আছেন?’

জোহরা কিছু বলার আগেই কিচেনে খাড়া-কান কুসুম তির হানে, ‘তোমার বাবা-মা-এটা কেমন কথা? আব্বু-আম্মু বলতে লজ্জা লাগে?’

না, লজ্জা লাগে না। কিন্তু আমার বাবা-মায়ের প্রসঙ্গ এলে কুসুম ঠিকই বলে-‘তোমার বাবা, তোমার মা’! এখানে কোনো কসুর নেই! যত রোষ, জামাই ঘোষ। কুসুমের বাবা-মাও আমাকে প্রায়ই ঠেলে দেয় মিথ্যার ফাঁদে। ওদের বড়বাড়ির উৎসুক প্রতিবেশীরা জানতে চায়- ‘তোমাগো জামাই কী করে?’

ন্যায়পরায়ণ শাশুড়ি স্ট্যাটাস উঁচু রেখে অবলীলায় মিথ্যা বলেন, ‘বাবাজি তো সচিব।’

সচিব দূরঅস্ত, সচিবালয়ের পিয়নের চাকরিটাও জোটাতে পারিনি। চেষ্টা-চরিত্র প্রচুর করেছি। বর্তমানে সচিবালয় এলাকার একটা অফিসে চাকরি করি। ভুয়া পরিচয় পেয়ে যদি গ্রামের লোকজন তদবিরের জন্য আসে, কী করব! গোবেচারা স্বামী আমি, জলে ডুবি আবার ডাঙায় রক্তাক্ত হই।

মৃদু-মন্থর প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হয় না। সবকিছু ফেল মারে, বউই যেখানে মুখ্য কর্মসচিব! শ্বশুর রাজ্য প্রধান হলে শাশুড়ি ফার্স্টলেডি! সেক্ষেত্রে কর্মসচিবের অলংকারিক পদ হবে আয়রনলেডি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম