
প্রিন্ট: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৩২ পিএম
‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’র মোটিফে আগুন
ফ্যাসিবাদের অনুসারীরা এসব ঘটিয়েছে : সংস্কৃতি উপদেষ্টা

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার
প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে নববর্ষের শোভাযাত্রা উদযাপনের জন্য বানানো দুটি মোটিফ শনিবার ভোরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। চারুকলা অনুষদের ভেতরের এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এদিকে মোটিফে আগুন লাগার পর আনন্দ শোভাযাত্রার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, বৈশাখের শোভাযাত্রার র্যালির অনুষঙ্গ যারা পুড়িয়ে দিয়েছে তারা জুলাই আন্দোলনকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ফ্যাসিবাদের অনুসারীরা এসব ঘটিয়েছে। শনিবার দুপুরে সিলেট সার্কিট হাউজে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ মোটিফে আগুন দেওয়া একজনকে শনাক্ত করা গেছে। কালো টি-শার্ট, জিন্সের প্যান্ট, কালো স্যান্ডেল পরা ও পেছনে চুল ঝুটিবাঁধা এক তরুণ চারুকলার মাঝখানের গেট টপকে ভেতরে প্রবেশ করে এবং আগুন দিয়ে একই পথে পালিয়ে যায়। তবে এখনো তার নাম-পরিচয় জানা যায়নি। শনিবার সিসিটিভি ক্যামেরা বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমেদ সিসিটিভি ফুটেজে এসব তথ্য পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেন।
সূত্র জানায়, নববর্ষের শোভাযাত্রা উদযাপনের জন্য নির্মিত মোটিফের নিরাপত্তার জন্য রাতে ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের কেউ। পুলিশ থাকলেও তাদের অবস্থান ছিল গেটের বাইরে। যার ফলে নিরাপত্তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। প্রক্টরিয়াল টিমের একাধিক সদস্য বলেন, আমাদের রাতে ডিউটিতে ছিলেন মাত্র চারজন। তবে এইখানে কেউ ছিলেন না। রাত ৮টার দিকে আমরা চলে যাই। পুলিশ গেটে দায়িত্বে ছিল। গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, চারুকলার শোভাযাত্রা নিয়ে আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল আয়োজকদের। যে কোনো সময় ফ্যাসিস্টের সহযোগীরা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটাতে পারে। এরপরও নিরাপত্তা নিয়ে জোরালো পদক্ষেপ ছিল না বলে অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন এসআই তারক কুমার হালদার। নিরাপত্তা নিয়ে তাদের ভূমিকা কি ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। ওসি স্যারের সঙ্গে কথা বলে আপনাকে বলব।’
নিরাপত্তার বিষয়ে শোভাযাত্রার আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ও চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম শেখ বলেন, ‘এগুলো সবই জানা যাবে। আমরা ফুটেজ দেখার চেষ্টা করছি। ফুটেজ দেখে বলা যাবে।’ তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদের দাবি, প্রক্টরিয়াল টিমের দুজন দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ভোর ৪টা থেকে ৫টার ভেতরে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ সময় দায়িত্বরত প্রক্টরিয়াল টিমের দুই সদস্য নামাজে গিয়েছেন। এছাড়া দারোয়ান ঘুমিয়ে ছিলেন।’
তিনি জানান, ‘আমরা অনুমান করছি কেউ পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়েছে। আবার তা নাও হতে পারে। ঘটনাস্থলে সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। ক্যামেরার পাসওয়ার্ড ভুলে যাওয়ায় এখনো ফুটেজ দেখা সম্ভব হয়নি। তবে ভিন্নভাবে এ ফুটেজ দেখার চেষ্টা চলছে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক মো. ইস্রাফিল প্রাং। তিনি বলেন, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ভোর বেলায় জিন্সের প্যান্ট ও কালো শার্ট পরা এক যুবক ঘটনাস্থলে প্রবেশ করে। তার মুখে মাস্ক ছিল, চেহারা বোঝা যাচ্ছিল না। তবে তার মধ্যে কোনো ধরনের চঞ্চলতা বা উদ্বিগ্নতা দেখা যায়নি। সে খুব ধীরস্থিরভাবে প্রতিকৃতিতে প্রথমে আগুন লাগায়। প্রথমে লাগানো আগুন কিছুক্ষণ জ্বলে নিভে যায়। পরে আবারও আগুন লাগায় সে।ওই ব্যক্তিকে শনাক্ত করা গেছে কিনা, তিনি ক্যাম্পাসের ভেতরের কেউ নাকি বাইরের কেউ এমন প্রশ্নের জবাবে সহকারী প্রক্টর বলেন, পরিচয় এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। এ বিষয়ে আমরা তদন্ত করছি। তবে তার মুভমেন্ট দেখে বোঝা গেছে, এখানকার পরিবেশ তার খুব পরিচিত।
চারুকলা অনুষদের দুঃখ প্রকাশ : নববর্ষের শোভাযাত্রা উপলক্ষ্যে বানানো ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতিতে দুর্বৃত্তদের আগুন দেওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে চারুকলা অনুষদ। শনিবার (১২ এপ্রিল) সকালে এক বিজ্ঞপ্তিতে চারুকলা অনুষদ জানায়, এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আজহারুল ইসলাম শেখ স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পহেলা বৈশাখ ও বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ উদযাপনের লক্ষ্যে আনন্দ শোভাযাত্রার জন্য বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রতীকী মোটিফ বানান।
অন্যান্য মোটিফের সঙ্গে প্রতীকী দানবীয় ফ্যাসিস্টের মোটিফ বানানো হয়। অনুষদের দক্ষিণ পাশের গেটসংলগ্ন জায়গায় প্যান্ডেলের ভেতরে এই মোটিফগুলো রাখা হয়। কে বা কারা এর মধ্য থেকে ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতির মোটিফটি পুড়িয়ে দেয়। এ ঘটনায় শান্তির পায়রা মোটিফটিও আংশিক পুড়ে গেছে।
ভোর ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে ওই আগুন লেগেছে মর্মে ধারণা করা হচ্ছে বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এ ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগ থানায় প্রথমে একটি সাধারণ ডায়রি করা হয়। পরে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাবি স্টেট অফিস থেকে একটি মামলা করা হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী অঙ্গ-সংগঠনের অজ্ঞাতনামা আসামিরা মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের জন্য এ জাতির ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংস, পহেলা বৈশাখ ও বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর শোভাযাত্রা বানচালসহ দেশকে অস্থিতিশীল করতে শনিবার ভোর ৪টা ৫০ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের দক্ষিণ পাশের গেটসংলগ্ন জায়গায় স্থাপিত প্যান্ডেলে প্রবেশ করে। এরপর তারা প্যান্ডেলের ভেতরে নির্মিত বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী মোটিফের মধ্যে দানবীয় ফ্যাসিস্টের প্রতীকী মোটিফটিতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল টিম প্যান্ডেলের ভেতর আগুন দেখে দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে আসামিরা দ্রুত পালিয়ে যায়। ডিউটিরত থানা পুলিশসহ প্রক্টরিয়াল টিম আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। পরে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। দানবীয় ফ্যাসিস্টের প্রতীকী মোটিফটি সম্পূর্ণভাবে এবং পাশে থাকা শান্তির প্রতীক কবুতরের মোটিফটির বেশিরভাগ অংশ পুড়ে যায়।
সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টার বক্তব্য : সিলেট ব্যুরো জানায়, সংবাদ সম্মেলনে দুষ্কৃতকারীদের সতর্ক করে সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলেন, ইতোমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে সরকার তার স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরেছে। অপরাধীদের দ্রুত সময়ের মধ্যই গ্রেফতার করা হবে। তিনি আরও বলেন, জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। সবার ঐক্য দিয়ে এসব অপকর্মের প্রতিবাদ হবে মুখ্য জবাব। এবার সব ধর্ম জাতি সবার সমন্বয়ে বিশাল আয়োজন হচ্ছে শুধু বৈশাখকে কেন্দ্র করে যা দেশকে নতুন ভাবে চিনবে মানুষ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মোহাম্মদ রেজাউন্নবী ও জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ।