
প্রিন্ট: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৫৫ পিএম
‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র নাম বদল
এবার ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’
নাম পরিবর্তন নয়, পুরোনো নাম-ঐতিহ্যে ফেরত যাচ্ছি -ঢাবি উপাচার্য * থাকবে ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’, বাঘ, ইলিশ ও ৩৬ জুলাই টাইপোগ্রাফিসহ বিভিন্ন মোটিফ

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
অবশেষে বাঙালির বর্ষবরণ পহেলা বৈশাখের অন্যতম উদযাপন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র নাম পরিবর্তন হলো। ‘মঙ্গল’ বাদ দিয়ে শোভাযাত্রার নামকরণ করা হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। শুক্রবার বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলাম শেখ এবারের শোভাযাত্রার নাম ঘোষণা করেন। তবে আয়োজকসংশ্লিষ্টরা নাম বদল না বলে, এটাকে ‘পুনরুদ্ধার’ বলে মনে করছেন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান, বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ উদযাপনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক এম. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ উদযাপনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সদস্য-সচিব অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলাম শেখ, শোভাযাত্রার উপ-কমিটির সদস্য-সচিব অধ্যাপক এএএম কাওসার হাসান, প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদ প্রমুখ।
শোভাযাত্রার আয়োজকেরা বলছেন, এবার শোভাযাত্রা হবে অনেক অন্তর্ভুক্তিমূলক। দেশে বসবাসরত ২৮টি জনগোষ্ঠীর লোকজন শোভাযাত্রায় অংশ নেবেন। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের বার্তা দেবে এবারের শোভাযাত্রা।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আজহারুল বলেন, আগেও পয়লা বৈশাখে চারুকলা থেকে যে শোভাযাত্রাটি হতো, তার নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। সেটি পরে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ করা হয়েছিল। আমরা আবার ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’য় ফিরে গেলাম। এটাকে পুনরুদ্ধার বলা যেতে পারে।
জানা যায়, চারুকলা ১৯৮৯ সাল থেকে পহেলা বৈশাখে শোভাযাত্রা করে আসছে। শুরুতে নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে অমঙ্গলকে দূর করে মঙ্গলের আহ্বান জানিয়ে শোভাযাত্রার নামকরণ হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিও পায় এ কর্মসূচি।
চারুকলার ডিন বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাপক এই আয়োজনের লক্ষ্যে শোভাযাত্রার নামকরণ করা হয় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’, যার ছায়াতলে দেশের সব বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটবে। প্রতিফলিত হবে বর্তমানের সব শ্রেণির মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা এবং ফুটে উঠবে শোভাযাত্রার প্রকৃত আনন্দ।
নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমরা নাম পরিবর্তন করছি না। আমরা পুরোনো নাম ও ঐতিহ্যে ফেরত যাচ্ছি, যেটা দিয়ে চারুকলার এই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।
উপাচার্য আরও বলেন, এই শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্যে দুটো মেসেজ (বার্তা) আছে। একটি হচ্ছে, একটি নিবর্তনমূলক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার অবসান। রাজনৈতিক ও সামাজিক নিবর্তনমূলক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ, সেই বিষয়টি তুলে ধরা। কিছু মোটিফ সেই কাজটি করছে। আর দ্বিতীয় যে অংশটি আছে, সেটি হচ্ছে মূলত ঐক্যের ডাক, সম্প্রীতির ডাক।
কী কী থাকছে : আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজনে থাকবে বড় মোটিফ, মাঝারি মোটিফ, ছোট মোটিফ। এর মধ্যে বড় মোটিফ থাকবে ৬টি। সবার সামনে থাকবে ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’। এই মোটিফটির বিষয়ে অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান বলেন, ফ্যাসিস্টের প্রতিকৃতি দেখে কেউ যদি কারও সঙ্গে মিল খুঁজে পান, তা প্রত্যকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা সামগ্রিকভাবে ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে আমাদের অবস্থান তুলে ধরছি।
শোভাযাত্রায় বড় মোটিফের মধ্যে থাকবে কাঠের বাঘ, ইলিশ, ৩৬ জুলাই (টাইপোগ্রাফি), শান্তির পায়রা, পালকি, জুলাই আন্দোলনে নিহত মুগ্ধের পানির বোতল। এছাড়া অন্যান্য মোটিফের মধ্যে থাকবে-১০টি সুলতানি ও মোগল আমলের মুখোশ, ৮০টি ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি, ২০টি রঙিন চরকি, ২০০টি বাঘের মাথা, ৮টি তালপাতার সেপাই, পলো ১০টি, ৫টি তুহিন পাখি, ৬টি মাছের চাঁই, ৪টি পাখা, ২০টি মাথাল, ২০টি ঘোড়া, ৫টি লাঙল, ৫টি মাছের ডোলা এবং ১০০ ফুট লোকজ চিত্রাবলীর ক্যানভাস ১০০ ফুট থাকবে।
চারুকলার সম্মুখভাগের দেয়ালে আঁকা হচ্ছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ির মোটিফ। জয়নুল শিশু নিকেতন দেয়ালে আঁকা হচ্ছে সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী মাটির দেওয়াল অমনরীতি অবলম্বনে চিত্র।
শোভাযাত্রায় ফিলিস্তিনি গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হবে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, তরমুজ ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘প্রতিরোধ ও অধ্যবসায়ের প্রতীক’। ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি প্রতীক হিসাবে উপস্থাপন করা হলেও মূলত এটি তাদের পতাকা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর কারণ হলো, ফলটির বাইরের অংশের রঙ সবুজ। আর ভেতরের অংশগুলোর রং লাল, সাদা ও কালো। এ রংগুলো ফিলিস্তিনের পতাকার রংয়ের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এবারের শোভাযাত্রায় অন্যান্য মোটিফের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মুসলমানদের লড়াইয়ের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে তাদের প্রতীক হিসাবে তরমুজের মোটিফ থাকবে।
চৈত্র সংক্রান্তিতে চারুকলায় আয়োজিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এ আয়োজন চলবে। চারুকলা অনুষদ থেকে সকাল ৯টায় বের হবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। এ সময় শাহবাগ ও টিএসসির মেট্রোরেল স্টেশনে ট্রেন থামবে না, তবে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক থাকবে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
শোভাযাত্রাটি চারুকলা অনুষদ থেকে শাহবাগ হয়ে টিএসসি, শহিদ মিনার, দোয়েল চত্বর হয়ে চারুকলা অনুষদ পর্যন্ত প্রদক্ষিণ করবে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এবারের শোভাযাত্রায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সামনে না থেকে দুই পাশে হাঁটবেন। নিরাপত্তা নিয়ে কোনো রকম শঙ্কাও নেই বলে জানানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিকাল ৫টার পর প্রবেশ করা যাবে না। নগরীর অন্যান্য স্থানে সন্ধ্যার পরও বর্ষবরণের আয়োজন থাকবে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকাল ৫টার মধ্যেই আয়োজন শেষ করা হবে।
এই আয়োজনকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হবে উল্লেখ করে চারুকলার ডিন বলেন, বাক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা এবং মননের মুক্তির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে দেশের প্রতিটি মানুষকে অন্ধকার কাল থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার বার্তা দিতে হবে।
এবারের বৈশাখ হবে সবার উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের ভূ-খণ্ডে বসবাসরত সব জাতিগোষ্ঠী এবারের বৈশাখ বরণের অংশীদারত্ব অর্জন করেছে। পাহাড় থেকে সমতল সবাই একসঙ্গে বর্ষবরণ উদযাপন করবো। এবারের আয়োজনের মধ্য দিয়ে একপেশে সংস্কৃতি চর্চার সংকীর্ণতা থেকে বের হয়ে আমরা বাংলাদেশের সংস্কৃতির উদার ও শুদ্ধ চর্চার দিকে অগ্রসর হতে পারব বলে আশা করছি।