
প্রিন্ট: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৪২ এএম

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস
আরও পড়ুন
বাংলাদেশ অদ্ভুত ধারণার (ক্রেজি আইডিয়া) এক দেশ। তবে এ ধারণাগুলো দেশটি বাস্তবে রূপ দিতে পারে। বদলে দিতে পারে বিশ্ব। এ দেশ সত্যিই এক অপার সম্ভাবনার। সুতরাং বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে বিশ্ব পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারেন। বুধবার রাজধানীতে আয়োজিত বিনিয়োগ সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সকাল ১০টায় রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত চার দিনব্যাপী এ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের দীর্ঘ পথচলার কথা বলতে গিয়ে কাঁদলেন এই নোবেল বিজয়ী। তুলে ধরেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের পর থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দেশের নানা ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অর্জনের কথা। কীভাবে গ্রামীণ ব্যাংক মানুষের অর্থনৈতিক পরিবর্তনে কাজ করেছে, তা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এক আশ্চর্য যাত্রা। খুব অল্প সময়েই অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এখন বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত জায়গা আমাদের প্রিয় এ দেশ। এখানে বিনিয়োগ শুধু একটি দেশের জন্য নয়, এটি অত্যন্ত শক্তিশালী এলাকা (পাওয়ারফুল এরিয়া)।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, আপনারা বিনিয়োগের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন। এখানে একসঙ্গে কাজ করে বিশ্ব পরিবর্তনে ভূমিকা রাখেন। এক্ষেত্রে সরকার সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত। ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসা নিয়ে আসুন। এর মাধ্যমে বিশ্ব বদলে দিতে ভূমিকা রাখুন। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যার কাছে বিশ্বকে বদলে দেওয়ার অভিনব সব ধারণা রয়েছে। এসব ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। তাই আপনাদের আমন্ত্রণ জানাই, শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বকেই বদলে দেওয়ার যাত্রায় যুক্ত হন।
অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, আপনি কোনো লক্ষ্য নিয়ে ব্যবসা করতে চাইলে বাংলাদেশই তা পূরণ করতে পারবে। কারণ, বাংলাদেশ কাজ করে দেখায়। আর একবার কেউ শুরু করলে অন্যরাও অনুসরণ করে। কীভাবে মানুষ ব্যবসার মাধ্যমে সুখী হয়, এর বর্ণনা করে তিনি বলেন, টাকা উপার্জন করে মানুষ নিঃসন্দেহে আনন্দ পায়। কিন্তু অন্যকে সুখী করার মধ্যে অতিরিক্ত আনন্দ নিহিত রয়েছে।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বিডার নির্বাহী পরিচালক চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, ইউকের বাংলাদেশবিষয়ক বাণিজ্যদূত ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটন, ইন্ডিটেক্সের সিইও অস্কার গার্সিয়া মাসেইরাস এবং অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। অর্থনৈতিক অগ্রগতি, বিনিয়োগবান্ধব নীতি এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির বিভিন্ন বিষয়ে তুলে ধরেন বিডার চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ঝুঁকিও বেশি, মুনাফাও বেশি।
বিনিয়োগ সম্মেলনে বিভিন্ন খাতের অবদানের জন্য ৪টি প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার তুলে দেন প্রধান উপদেষ্টা। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী। এদিন স্টারলিংকের ইন্টারনেটের পরীক্ষামূলক উদ্বোধন করা হয়।
সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমে ব্যবসায়ীদের যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বিনিয়োগ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসা করলে আপনি সুখ এবং অতিরিক্ত আনন্দ-দুটিই পাবেন। কোনো খরচ ছাড়াই এ অতিরিক্ত আনন্দ লাভ করতে পারেন। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, এখানে বিনিয়োগ করলে পুরো এ অঞ্চলের বিশাল সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে। তার মতে, অর্থ উপার্জন এবং মানুষের জীবন পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য বিশ্ব বদলে দেওয়ার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এর মাধ্যমে গঠন করতে হবে নতুন সভ্যতা।
তিনি বলেন, ‘আমরা তিন শূন্য’র একটি পৃথিবী তৈরি করতে পারি। এটা ব্যবসার মাধ্যমেই সম্ভব। কারণ এটা সরকারের কাজ নয়, মানুষ হিসাবে আমাদের কাজ। আমরাই বিশ্বকে বদলে দিতে পারি। নতুন সভ্যতা হবে এমন একটি সভ্যতা, যেখানে কার্বন নির্গমন থাকবে না। তার মতে, অর্থ উপার্জন আনন্দের হলেও সম্পদের কেন্দ্রীকরণ মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক। এটি পুরো পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলবে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের সময় মানুষের কষ্টের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই সময় প্রায় ১৫ লাখ মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা গেছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ওই সময়ে আমরা এক ফসলই ফলাতাম। আর কোনো উপায় জানা ছিল না। জনসংখ্যা কৃষক হিসাবেই পরিচিতি পেয়েছে। কারণ, তাদের আর কোনো পেশা ছিল না। তাদের মধ্যে ছিল ভূমিহীন কৃষকও। যাদের নিজের কোনো জমি ছিল না। যারা অল্প জমির মালিক ছিল, তাদের কাছ থেকে সামান্য জমি লিজ নিয়ে এক ফসল ফলিয়ে জীবিকা চলাতে হতো এসব ভূমিহীনদের। আপনি যদি ‘চরম দারিদ্র্য’ শব্দটা শুনে থাকেন, সেটাই ছিল ওই সময়কার বাংলাদেশ। তখন জীবনটা ছিল খুব কঠিন। তবে ১৯৭৪ সাল থেকে এ স্বল্প সময়ের যাত্রায় আমরা এক অভূতপূর্ব অবস্থানে চলে এসেছি। এ সময়ে আবেগ ও কান্নায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ড. ইউনূস বলেন, আপনারা আমাদের এই অগ্রযাত্রায় শামিল হন।
বিডা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে ১৭ কোটি মানুষের বাজার। এর বাইরেও এখানে বিনিয়োগ করে নেপাল, ভুটান ও ভারতের সেভেন সিস্টারে পণ্য পাঠানো যায়। বর্তমানে বিশ্বের যেসব বহুজাতিক কোম্পানির বাংলাদেশে বিনিয়োগ রয়েছে, তাদের অবস্থা তুলে ধরে আশিক চৌধুরী বলেন, এখানে বিনিয়োগে যেমন উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে, তেমনিভাবে মুনাফাও বেশি। যেসব কোম্পানি এখানে বিনিয়োগ করেছে, তাদের মুনাফা বিশ্বের অন্যান্য দেশের গড় মুনাফার চেয়ে বেশি।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাংলাদেশের কোম্পানি ‘শপআপ’ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবের বড় বিনিয়োগ পেয়েছে। দেশটির প্রযুক্তি খাতের কোম্পানি ‘সারি’-এর সঙ্গে একীভূত হয়ে নতুন কোম্পানি গঠন করেছে শপআপ। ওই কোম্পানির নামকরণ করা হয়েছে ‘সিল্ক’ গ্রুপ। নতুন গ্রুপ গঠনের পরপরই ১১ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। স্থানীয় মুদ্রায় যা হাজার কোটি টাকার বেশি। এছাড়াও অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই হয়।
আয়োজকরা জানান, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে এই আয়োজন করেছে বিডা। এতে ৪০টির বেশি দেশের সাড়ে ৫০০ বিদেশি বিনিয়োগকারী অংশ নিয়েছেন। এর বড় অংশই চীনের। এছাড়াও যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান ও ভারতের বিনিয়োগকারীরা এসেছেন। দেশীয় ২ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। প্রথমদিন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দলটি চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল ও কোরিয়ান ইপিজেড পরিদর্শন করে। দ্বিতীয় দিনে মঙ্গলবার তারা নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপানের অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করে। বুধবার ছিল তৃতীয়দিন। তবে এদিনই সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা। অনুষ্ঠানে স্টারলিংকের ইন্টারনেট পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়। এ ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করে সম্মেলনের সব ইভেন্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ সম্প্রচার করা হয়। বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশ সরেজমিন তুলে ধরে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোই এ আয়োজনের উদ্দেশ্য। বেশ কয়েকটি দেশের বড় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। আয়োজকরা জানান, এই আয়োজনের মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের জন্য একটি বিনিয়োগের পাইপলাইন তৈরি হবে।
পুরস্কার প্রদান : দেশের বিনিয়োগে অবদান রাখার জন্য চার ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার তুলে দিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে দেশি বিনিয়োগকারী ক্যাটাগরিতে ‘স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ও ওয়ালটন’, বিদেশি বিনিয়োগকারী ক্যাটাগরিতে ‘বিকাশ’ এবং উদ্ভাবন খাতে ‘ফেব্রিকস লাগবে’। এছাড়া বিশেষ ক্যাটাগরিতে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের চেয়ারম্যান কিহাক সাংকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।