
প্রিন্ট: ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১০ পিএম

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
মার্কিন পণ্যের শুল্ক ও অশুল্ক বাধা তুলে দিয়ে আগামী দিনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ানোসহ চারটি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। অন্য দুটি হচ্ছে-আমেরিকার বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তৈরি পোশাকশিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পণ্যের পাশাপাশি সেবা (সার্ভিস) আমদানি।
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বল্প মেয়াদের উল্লিখিত কৌশলের কথা তুলে ধরে দুদিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দেবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একইভাবে ইউনাইটেড স্টেটস অব ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভের (ইএসটিআর) অফিসকে চিঠি দেবেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি এবং মার্কিন পণ্যে শুল্কহার অনেক বেশি, এ যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশি পণ্যে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সেটি মোকাবিলা করতে এ কৌশল প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের পালটা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা স্থগিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ ঘটনাকে হাইপারডাইনামিক স্টোরি বা অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কাহিনি বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। ট্রাম্প প্রশাসনের ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ইস্যু নিয়ে রোববার সকালে ঢাকার গুলশানে মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গে তার বাসভবনে অনুষ্ঠিত ‘ব্রেকফাস্ট অন ট্রেড ব্যারিয়ার্স’ বৈঠক করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। ওই বৈঠক শেষে সচিবালয়ে কয়েকজন সাংবাদিকের কাছে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন বাড়তি আরোপিত শুল্ক তুলে নেওয়া বা পুনর্বিবেচনার জন্য দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা হবে। আর মার্কিন পণ্যে বাংলাদেশ ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের হিসাবের প্রকৃত তথ্য ওই চিঠিতে তুলে ধরা হবে। কারণ, শুল্কহার ৭৪ শতাংশ নয়, এটি বাস্তবে ৫ শতাংশের নিচে।
বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যে ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ মোকাবিলায় কৌশল ঠিক করতে রোববার দফা দফায় তিনটি বৈঠক হয়েছে। ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গে সকালে নাশতার টেবিলে বৈঠক করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। এছাড়া দুপুরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ীদের এবং সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সঙ্গে দ্বিতীয় বৈঠক করেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান। সর্বশেষ সরকারের নীতিনির্ধারণী, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রধান ও ব্যবসায়ীরা যৌথভাবে বৈঠক করেছেন অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে।
বিকালে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বৈঠক শেষ সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো হবে। এজন্য মার্কিন পণ্য বেশি আনার প্রয়োজন হলে আমদানি বাড়ানো হবে। এক্ষেত্রে তরলীকরণ গ্যাস এলএনজিসহ অন্য পণ্যও আমদানি করব। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সক্ষমতা আরও বাড়ানো হবে। কারণ, আমেরিকার ক্রেতারা মনে করছেন, অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশি পণ্য অনেক ভালো। তবে বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য আগামী দিনে মার্কিন পণ্যের সঙ্গে সেবাও আমদানি করা হবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কারণ, সেখানে অনেক সেবা আছে, যেগুলো আমদানি করার মতো।
অর্থ উপদেষ্টা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন মার্কিন পণ্য শুল্ক ও অশুল্ক বাধার ওপর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন অনেক ধরনের অফিশিয়াল নিয়মনীতি করে রাখা আছে। যার কারণে মার্কিন ব্যবসায়ীরা বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। অশুল্ক বাধাগুলো তুলে নেওয়া হবে। এটি দ্রুত আরও সহজ করা হবে।
ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাড়তি শুল্ক আরোপের কারণে আমেরিকার বিপক্ষে ইউরোপ ও চীন কিছু পদক্ষেপ নেবে। এতে বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের নড়াচড়া খাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা সবকিছুই মাথায় রাখছি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত রক্ষা করতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা আরও বাড়ানো হবে। যাতে অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে টিকে থাকতে পারে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে সহায়ক কৌশল উপস্থাপন হচ্ছে মূল লক্ষ্য-এমনটি জানান বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি আরও বলেন, আমাদের বাণিজ্যের জন্য সহায়ক শুল্ক ও অশুল্ক বাধাগুলো রহিত এবং পূর্ণ মূল্যায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, আমেরিকার শুল্ক আরোপের পর বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোনো প্রতিক্রিয়ায় যাব না। আমরা দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেব এবং ক্লোজ মনিটরিং করা হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হবো।
এ সময় প্রধান উপদেষ্টার উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান বলেন, গত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্কিন প্রতিনিধির সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করছি। তবে দেশের স্বার্থ বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বেশ বাড়ানো সম্ভব। এর উপায় খোঁজা হচ্ছে। এ নিয়ে ব্যবসায়ী কমিউনিটির সঙ্গে আলোচনায় একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। শনিবার রাতেও ইউএসটিআরের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কথা বলেছেন। সেখান থেকে যে সংকেত মিলছে তা আমাদের চিন্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে আগামী দু-একদিনের মধ্যে সরকারের কৌশল চূড়ান্ত করা হবে।
স্কয়ার গ্রুপের সিইও তপন চৌধুরী বলেন, আমরা যতটা উদ্বিগ্ন ছিলাম আজকের আলোচনা থেকে একটি পথনির্দেশনা পেয়েছি। সব সময় মনে করা হয় তৈরি পোশাকই একমাত্র রপ্তানির ঝুড়িতে আছে। এটি ঠিক, অন্য পণ্যও রয়েছে। সংকটের মধ্যে বেশ কিছু সুযোগ আসছে। বর্তমান সরকারের যোগাযোগের মাধ্যমে এ চ্যালেঞ্জ উত্তরণ ঘটাতে পারব।
লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি) প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণের কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্বস্তির জায়গা তৈরি হয়েছে। আমি মনে করি দেশের স্বার্থ মাথায় রেখে সুযোগগুলো খুঁজে বের করতে হবে। একটি বিষয়ে সবাই একমত হবো-বাংলাদেশ যেন প্রতিযোগিতার সক্ষমতা না হারায়। এখানে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ থাকলে বেসরকারি খাত থেকে সেটি অর্জন সম্ভব। আর ‘লেভেল প্লেয়িং ফ্লিড’ তৈরির দায়িত্ব সরকারের। এজন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা লাগবে। নতুন নতুন অনেক পণ্য রপ্তানি হচ্ছে আমেরিকায়। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারকে এড়িয়ে গেলে চলবে না।
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের জানান, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দুটি চিঠি যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও ট্রাম্প প্রশাসনকে পাঠানো হবে।
বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের বৈঠক : ট্রাম্প প্রশাসনের ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ইস্যু নিয়ে রোববার সকালে ঢাকার গুলশানে মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গে তার বাসভবনে অনুষ্ঠিত ‘ব্রেকফাস্ট অন ট্রেড ব্যারিয়ার্স’ বৈঠক করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। ওই বৈঠকে শিল্প উপদেষ্টা মো. আদিলুর রহমান খান, প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘ভালো হয়েছে। আমরা একটা ধারণা পেয়েছি যে, আমাদের ধরনের অর্থনীতি যারা আছে, পালটা শুল্ক আরোপের কারণে তারা কী অনুসরণ করছে এবং আমরা কী পদক্ষেপ নিতে পারি।’
শুল্ক আরোপের কার্যকরের তারিখ যদি ৯ এপ্রিল হয়, তাহলে পেছানোর কোনো সুযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না। ৯ তারিখের কথাটাও বোঝার চেষ্টা করেছি যে স্থগিতাদেশের (সাসপেনশন) কোনো সম্ভাবনা বৈশ্বিকভাবে আছে কিনা। তাদের কথা হচ্ছে এ ধরনের কোনো সম্ভাবনা নেই।
শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা ধারণা ঘুরে বেড়াচ্ছে যে ৯ তারিখে কোনো কোনো দেশের জন্য স্থগিতাদেশ আসবে। আমরা এ ধরনের কোনো ধারণা পাইনি। ব্যাপারটা হচ্ছে যে এটা একটা হাইপারডাইনামিক স্টোরি এবং বিশ্ব বাণিজ্যে এর প্রভাব পড়েছে। দেখা যাক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মহাপরিচালকও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
বৈঠকে মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স কিছু বলেছেন কিনা জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, তারা তো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলবে না। আলোচনা হয়েছে, কিছু দিকনির্দেশনা পেয়েছি। এর মধ্য থেকে আমরা কী প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হব তা বোঝার চেষ্টা করেছি। অবশ্য গতকালই (শনিবার) বলার চেষ্টা করেছি যে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে মূল যোগাযোগের কাজটা করবেন। আর আমরা যারা দায়িত্বে নিয়োজিত আছি, তারা অপর পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাকি কাজটা করব।’
উপদেষ্টা বলেন, আমাদের পর্যায়ের যোগাযোগের পদ্ধতিগুলো কি, আকাঙ্ক্ষাগুলো কি, শুল্ক ও অশুল্ক বাধাগুলো কি এবং ব্যবসা করতে গিয়ে যেসব জায়গায় তাদের সমস্যা হচ্ছে, বৈঠক থেকে সেগুলো বোঝার চেষ্টা করেছি। আমাদের অর্থনীতির জন্য যেগুলো সহায়ক, সেগুলো তো আমরা করতেই চাই। তবে যেগুলো সহায়ক নয়, সেগুলো করা সম্ভব নয়-এরকম একটা আলোচনা করেছি।’