
প্রিন্ট: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ০১:০৪ এএম
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জরুরি বৈঠক
বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে সমাধানের চেষ্টা
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক ইস্যু: মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন ড. ইউনূস * আমদানি বাড়ানোই বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর উপায় * বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য আতঙ্কের নয়, সম্ভাবনার

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে নতুন শুল্ক আরোপ নিয়ে দেশটির প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ ব্যাপারে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে এনে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা চলছে। আমদানি বাড়ানোই, বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর উপায়। ইতোমধ্যে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ চলছে। দু-একদিনের মধ্যে অগ্রগতি জানা যাবে। তবে শুল্ক বাড়ানোর বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য আতঙ্কের নয়, সম্ভাবনার। বিষয়টি নিয়ে শনিবার প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
এর আগে খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। বৈঠক শেষে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। এ সময় আরও বক্তব্য রাখেন বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক বিন হারুন, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লুৎফে সিদ্দিকী। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। তাদের মতে, এই বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য নতুন নয়। ফেব্রুয়ারি থেকে এ ব্যাপারে তারা মার্কিন প্রশাসনের শুল্ক বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তাদের ধারণা শিগগিরই এর সমাধান হবে।
যমুনা অনুষ্ঠিত ওই জরুরি বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, অর্থ সচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লুৎফে সিদ্দিকী এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম। এর আগে শনিবার সকাল থেকে ব্যবসায়ীরা বিডার চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করেন।
প্রসঙ্গত, বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির ওপর নতুন করে ১০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করা হয়। তবে দেশটির বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগী ভিয়েতনামের ওপর ৪৬ এবং কম্বোডিয়ার ওপর ৪৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। এছাড়াও ভারতের ওপর ২৬ এবং চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্ক দেওয়া হয়। আর পাকিস্তানের ২৯ শতাংশ, শ্রীলংকার ৪৪ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ৩৬ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ার ২৫ শতাংশ, জাপানের ২৪ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ২৪ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। যে দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বেশি, সেই দেশের ওপর বেশি হারে শুল্ক আরোপ হয়েছে। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পালটা শুল্ক আরোপ করেছে চীন ও প্রতিবেশী কানাডা। চীন ৩৪ শতাংশ ও কানাডা ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের এই বৈঠক ডাকেন প্রধান উপদেষ্টা।
সংবাদ সম্মেলনে খলিলুর রহমান বলেন, শুল্ক আরোপের বিষয়টি আগেই তারা জানতেন। ‘ব্যাপারটা আকস্মিক নয়, আমরা এর জন্য প্রস্তুত।’ এটি কোনো আতঙ্কের বিষয় নয়। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে বৈঠক করতে বলেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। আমি সেই অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর, ট্রেড ও এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তখন থেকে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে ক্রমাগত এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। ওই সময় মার্কিন প্রশাসন বলেছে, এই বিষয়ে বাংলাদেশই সবার আগে যোগাযোগ করেছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করেই শিগগিরই একটি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর বাইরেও অনেক আলোচনা আছে। দেশের স্বার্থে সব কথা পাবলিকলি বলা যায় না।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ফেব্রুয়ারিতেই বাংলাদেশ শুল্ক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করেছে। তাই এখন পর্যালোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সর্বস্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে, আরও হবে। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমদানি বৃদ্ধির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘাটতি কমানোর প্রচেষ্টা করা হবে। শুল্ক বাড়ানো আকস্মিক বিষয় নয়। এতে বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছি। করণীয় বোঝার চেষ্টা করছি। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে এনে প্রতিযোগী দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, আমদানি বৃদ্ধির মাধ্যমে ঘাটতি কমানো যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন, শিল্পপণ্য, জ্বালানি পণ্য ও শিল্পের উপকরণ, তুলা আমদানি হয়ে থাকে। প্রয়োজনীয় এসব পণ্য আমদানি বৃদ্ধির মাধ্যমেই বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করব। আমাদের ধারণা, এতে কিন্তু আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো না। তিনি আরও বলেন, বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য একটি উপায় হলো আমদানি বৃদ্ধি। আমাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানি বৃদ্ধি করব। তবে আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত আমরা আমদানি করতে পারব না, সেটা যে পণ্যই হোক। বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় অর্থনীতিবিদরা উপস্থিত ছিলেন। এ বিষয়ে যারা ব্যাখ্যা করতে পারবেন তারাও উপস্থিত ছিলেন। আমদানি বৃদ্ধি করার মাধ্যমেই বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করা হবে।
সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল নতুন সিদ্ধান্তের ফলে পোশাক রপ্তানিতে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা। জবাবে তিনি বলেন, পোশাক খাতে কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার ওপর শুল্ক আরও বাড়ানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের শুল্ক কিছুটা কম হলেও তাদের পণ্যে বৈচিত্র্য নেই। অর্থাৎ সক্ষমতায় তাদের থেকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। তিনি বলেন, আমাদের সম্পদ প্রধান উপদেষ্টা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সবার কাছে তার ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে। আমরা এটাকে কাজে লাগাব। বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, বিষয়টি সমাধান হবে। বাণিজ্য ঘাটতির ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আমরা দেশটি থেকে আমদানি বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর মাধ্যমে এর সমাধানের চেষ্টা করব।
লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, ৫ থেকে ৬ মাস আগে এ বিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের তিনটি মূল্যায়ন আছে। একটি হলো শুল্ক, দ্বিতীয়ত মেধাস্বত্ব এবং সহজে ব্যবসা করা সংক্রান্ত সূচক। সেগুলো আমাদের সংস্কার কার্যক্রমের সঙ্গে মিলে যায়। ফলে বিষয়টি কোনো আতঙ্কের নয়। এর সমাধান হবে বলে আমরা মনে করি।
আশিক চৌধুরী বলেন, এ বিষয়টি আমরা দিনব্যাপী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমরা সবার পরামর্শ শুনেছি। সেই পরামর্শের আলোকে একটি সিদ্ধান্ত নেব।
অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্ককর কমানো যায় কিনা, তা পর্যালোচনা করছে এনবিআর। এ বিষয়ে এনবিআরের একটি দল কাজ করছে। আজ রোববার এ নিয়ে বৈঠক হবে। এনবিআর সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আড়াই হাজারের মতো পণ্য বছরে আসে। সেসব পণ্যের ওপর শুল্ককর কত, তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এসব শুল্ককর কমানোর সুযোগ আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে যেসব সেবা আমদানি করা হয়, সেখানেও শুল্ককর কমানোর বিষয়টি চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা লিজের পণ্যেও শুল্ককর সুবিধা বাড়ানো যায় কিনা, তাও দেখছে এনবিআর। এনবিআর কর্মকর্তারা শুধু আমদানি শুল্ক পর্যালোচনা করবেন না, ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, অগ্রিম কর-এসব শুল্ককরও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুই হাজার ৫১৫টি এইচএসকোডের পণ্য আমদানি হয়েছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে আট ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে ৬৭ শতাংশ। এনবিআরের তথ্যভান্ডারে দেখা যায়, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য আমদানি করেছে ২৬২ কোটি ডলারের পণ্য। এর মধ্যে ১৩৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানিতে কোনো শুল্ককর দিতে হয়নি। যেমন গম, তুলার মতো পণ্যে শুল্ককর নেই। এর পরও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া পণ্যে গড়ে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ শুল্ককর দিতে হয়েছে। সব মিলিয়ে কাস্টমস শুল্ককর আদায় করেছে এক হাজার ৪১১ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি পণ্যের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে রড তৈরির কাঁচামাল, পুরোনো লোহার টুকরো বা স্ক্র্যাপ। গত অর্থবছরে পণ্যটি আমদানি হয় ৭৭ কোটি ৮৬ লাখ ডলার, যা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া মোট পণ্যের প্রায় ২৭ শতাংশ। গড়ে ৪ শতাংশ শুল্কহার রয়েছে পুরোনো লোহার পণ্য আমদানিতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানি পণ্য এলপিজির উপাদান বিউটেন আমদানি হয়েছে ৩৩ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের। বাংলাদেশের শুল্কহার গড়ে ৫ শতাংশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ আমদানি সয়াবিন বীজ আমদানি হয়েছে ৩২ কোটি ডলারের। এই পণ্য আমদানিতে শুল্ককর নেই।