
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৩৫ পিএম
বিএফএ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস
সংস্কার বাস্তবায়নে জাতির মৌলিক রূপান্তর ঘটবে
ড. মুহাম্মদ ইউনূস-শি জিনপিং বৈঠক আজ

বাসস
প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে আমরা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার শুরু করেছি। এসব সংস্কার বাস্তবায়িত হলে জাতির মৌলিক রূপান্তর ঘটবে। বৃহস্পতিবার চীনের হাইনানে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ) সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে এশীয় নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মুনাফার চেয়ে মানুষ ও পৃথিবীকে অগ্রাধিকার দিয়ে টেকসই অর্থনৈতিক মডেলের দিকে অগ্রসর হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এ বছর বিএফএ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হলো-‘এশিয়া ইন দ্য চেঞ্জিং ওয়ার্ল্ড : টুওয়ার্ডস আ শেয়ারড ফিউচার’। ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে।
আমাদের তরুণ প্রজন্ম ও দেশবাসী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে অসাধারণ সংকল্প ও শক্তি প্রদর্শন করেছে। ড. ইউনূস বলেন, স্বাধীন কমিশন গঠন করা হয়েছে যাতে নির্বাচনি ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে সংস্কার আনা যায়। এ সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে আমাদের জাতির একটি মৌলিক রূপান্তর সাধিত হবে। তিনি বলেন, আমরা যখন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে যাচ্ছি, তখন এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো আমরাও একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি। বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারের অস্থিরতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, কূটনৈতিক উত্তেজনা এবং বাণিজ্য বিঘ্নতা বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি করছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সুদের হার বৃদ্ধি ও ঋণ পরিষেবা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এশিয়ার ঋণ সংকট আরও গভীর হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ধীরগতি লক্ষ করা যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী ২০৩০ এজেন্ডার প্রতি প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও অগ্রগতি খুব ধীরগতিতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মাত্র ২৪ শতাংশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জিত হয়েছে। দুর্নীতি ও আর্থিক অপচয় রোধের আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থপ্রবাহের শিকার। তিনি উল্লেখ করেন, এ ধরনের দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতিবছর প্রায় ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যা তারা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তা হিসাবে যে অর্থ পায় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ভবিষ্যতের চাকরির বাজারের জন্য প্রস্তুত করতে ডিজিটাল শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের প্রসার ঘটাতে হবে। তিনি বলেন, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন তীব্রতর হচ্ছে, ঋণের বোঝা অসহনীয় হয়ে উঠছে এবং মানবিক সংকট বাড়ছে। উন্নয়ন সহযোগিতার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং বিশ্ব এখন সম্মিলিত পদক্ষেপের অভাবের কারণে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন। এদিকে সম্মেলনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি-মুন, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মহাপরিচালক কু ডংগিউও, চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান চেন হুয়াইউ, চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়নার সাবেক উপগভর্নর উ শিয়াওলিং সাক্ষাৎ করেছেন।
মুনাফার চেয়ে মানুষকে অগ্রাধিকার দিতে হবে : ড. ইউনূস বলেন, মানুষ আত্মঘাতী অর্থনৈতিক মূল্যবোধকে ধারণ করে চলা অব্যাহত রেখেছে। এ কারণে মানবসভ্যতা ঝুঁকিতে পড়েছে। তিনি বলেন, আধিপত্যশীল অর্থনৈতিক মডেল সীমাহীন ভোগের ওপর নির্ভরশীল এবং প্রবৃদ্ধির নামে তা সম্পদের অতিরিক্ত উত্তোলন ও পরিবেশগত অবক্ষয়কে ন্যায্যতা দেয়। আমাদের অবশ্যই টেকসই অর্থনৈতিক মডেলের দিকে অগ্রসর হতে হবে, যা মুনাফার চেয়ে মানুষ ও পৃথিবীকে অগ্রাধিকার দেয়।
জলবায়ু সংকট মানবতার জন্য হুমকি : জলবায়ু সংকট মানবতার জন্য অস্তিত্বগত হুমকি হিসাবে দেখা দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জলবায়ু দুর্যোগজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতি ইতোমধ্যে বিশাল, যা প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে সম্পদ ব্যবহার করে দুর্যোগ মোকাবিলা করতে বাধ্য করা হচ্ছে, যা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ সীমিত করে দিচ্ছে। ড. ইউনূস বলেন, আমাদের নতুন, অতিরিক্ত, সহজলভ্য, বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগিতা, ঋণ সৃষ্টিকারী নয় এমন, অনুদানভিত্তিক জলবায়ু অর্থায়ন প্রয়োজন; যা অভিযোজন ও প্রশমনের মধ্যে ন্যায়সংগত বণ্টন নিশ্চিত করে।
রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন : ড. ইউনূস নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে এশীয় নেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ গত সাত বছর ধরে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে, যারা মিয়ানমারের নাগরিক। আমরা বিপুল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ব্যয় বহন করে চলেছি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি সংহতির নিদর্শনস্বরূপ রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, যদিও বৈশ্বিক প্রচেষ্টা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পাচ্ছে, তবে তা চলমান রয়েছে। এশিয়ার নেতাদের অবশ্যই একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে এবং তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে হবে।
গাজায় গণহত্যা চলছে : অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বর্তমান বিশ্ব বহুমুখী সংকটে ভুগছে, যেখানে যুদ্ধ ও সংঘাত মানবাধিকারের ক্ষতি এবং অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে। তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্বব্যাপী নিন্দা চলমান থাকলেও গাজায় গণহত্যা এখনো চলছে। ফিলিস্তিন সংকট শুধু আরব বা মুসলিমদের বিষয় নয়, এটি একটি মানবিক সমস্যা। প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ইউক্রেন সংকটের দীর্ঘায়িত উত্তেজনা বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং মিয়ানমারের দীর্ঘস্থায়ী সংকট আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমৃদ্ধ এশিয়া গড়তে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ : প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে এশীয় দেশগুলোর ভাগ্য পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। আমাদের অবশ্যই একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে, যা অভিন্ন ভবিষ্যৎ এবং যৌথ সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। আর্থিক সহযোগিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এশিয়াকে অবশ্যই একটি টেকসই অর্থায়নব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যাংক (এমডিবি) ও অনুরূপ প্রতিষ্ঠানগুলোর এই প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দেওয়া উচিত।
ডিজিটাল বৈষম্য : প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, তথ্যচালিত প্রযুক্তি, রোবটিক্স, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত অগ্রগতি ক্রমশ বিশ্বকে ভিন্ন একটি রূপ দিচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, উন্নত বিশ্বের তুলনায় এশিয়ার কম সক্ষমতা, সামর্থ্য এবং সম্পদ স্থানান্তর ডিজিটাল বৈষম্যকে আরও বিস্তৃত করতে পারে।
রাশিয়া বাংলাদেশে আরও গম ও সার রপ্তানিতে আগ্রহী : রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই ওভারচুক প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এ সময় আলেক্সেই বলেন, রাশিয়া বাংলাদেশে আরও গম ও সার রপ্তানি করতে চায়। বৈঠকে দুই নেতা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। যার মধ্যে রয়েছে-রাশিয়ার অর্থায়নে নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যক্রম এবং গ্যাজপ্রমের গ্যাস অনুসন্ধান। বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এবং প্রধান উপদেষ্টার উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
চীনের উপপ্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ : সম্মেলনের ফাঁকে চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী ডিং শুয়েশিয়াংয়ের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে ডিং বলেন, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আপনার সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করছেন। চীন আশা করে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সমৃদ্ধি অর্জন করবে। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ওয়ান-চায়না নীতি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দেওয়া প্রথম দক্ষিণ এশীয় দেশ হিসাবে ঢাকা গর্ব অনুভব করে।
শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক আজ : ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে বেইজিংয়ে পৌঁছেছেন। চীনের উপমন্ত্রী সান ওয়েইডং বেইজিং ক্যাপিটাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর আগে সন্ধ্যা ৭টায় অধ্যাপক ইউনূস হাইনান প্রদেশের বোয়াও শহর থেকে বেইজিংয়ের উদ্দেশে রওনা হন।
উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান, প্রধান উপদেষ্টা আজ সকাল ১০টায় বেইজিংয়ের গ্রেট হল অফ দ্য পিপলে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন।