‘ইনশাআল্লাহ আমরা উইন খরমু’
সিলেটে নেমে বললেন হামজা চৌধুরী

সিলেট ব্যুরো ও হবিগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সকাল থেকে উধাও চৈত্রের খরতাপ। মেঘলা আকাশ ও ঝিরিঝিরি বাতাস প্রকৃতিতে বুলিয়ে দিয়েছে মোলায়েম প্রলেপ। এমন দিনেই তো তাকে বরণ করা যায়। প্রকৃতির এমন সদয় হওয়ার দিনে সিলেটে এসে নামলেন বাংলাদেশ ফুটবলে সদ্য টাটকা বাতাস হয়ে আসা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা হামজা চৌধুরী। আগেও তিনি একাধিকবার এসেছেন। তবে এবারই প্রথম এলেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড় হয়ে। যুক্তরাজ্য থেকে ১৪ ঘণ্টার বিমানভ্রমণ শেষে সোমবার দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সিলেটে এসে পৌঁছলেন তিনি দুপুর পৌনে ১২টার দিকে। এ সময় সিলেট বিমানবন্দর পরিণত হয় জনসমুদ্রে। শয়ে শয়ে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বাল্ব ও মুঠোফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে ওঠে ঘনঘন। গোটা বিমানবন্দর পরিণত হয় শব্দের সমুদ্রে। প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে কোনোরকমে কোলাহলের মাঝে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে এসে হামজা সিলেটি ভাষায় বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ, আমরা উইন খরমু।’ এ সময় তার নামে মুহুর্মুহু স্লোগান দেন ভক্তরা। সকাল থেকে বিমানবন্দর এলাকায় ব্যানার, প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এ ব্রিটিশ ফুটবলারকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত হন ভক্তরা।
সিলেট বিমানবন্দর থেকে খোলা ছাদের গাড়িতে হামজাকে নিয়ে যাওয়া হয় হবিগঞ্জের বাহুবলে স্নানঘাটে তার বাবার বাড়িতে। সেখানে তিনি ইফতার করেন নিজের হাতে গড়া এতিমখানার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তার আগে বাড়ির আঙিনায় জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে হামজা বলেন, ‘এখনই বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখি না। লক্ষ্য পূরণে এগোতে চাই ধাপে ধাপে।’ লেস্টার সিটিতে তিনি খেলেছেন ১৭ নম্বর জার্সি গায়ে। বাংলাদেশ দলে খেলতে চান ৮ নম্বর জার্সি গায়ে। আপাতত তার ফোকাস এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে ভারতের বিপক্ষে ২৫ মার্চের ম্যাচে।
এর আগে সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ২টায় বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে ম্যানচেস্টার থেকে সিলেটে উড়াল দেন মিডফিল্ডার হামজা। হামজা ও তার পরিবারকে বরণ করে নিতে সিলেট বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন হামজার বাবা মোরশেদ দেওয়ান চৌধুরী এবং সিলেট ক্রীড়াঙ্গনের নেতারা। ছিলেন বাফুফের সাখাওয়াত হোসেন ভুইয়া শাহীন, কামরুল ইসলাম, গোলাম গাউস, ইকবাল হোসেন, সত্যজিৎ দাশ রুপু, ইমতিয়াজ হামিদ সবুজ ও মঞ্জুরুল করিম। ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার পর হামজাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন তারা।
হামজা এর আগেও বাংলাদেশে এসেছেন। তবে এবারই প্রথম বাংলাদেশ ফুটবল দলের খেলোয়াড় হয়ে এলেন তিনি। সিলেট বিমানবন্দর থেকে সরাসরি হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট গ্রামে চলে যান বাংলাদেশের ফুটবলে আলোর দিশারি হয়ে আসা হামজা। সেখানে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবেন তিনি। তার আগমনে হবিগঞ্জে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে। আজ রাতে তার ঢাকায় যাওয়ার কথা। পরদিন দুপুরে ইন্টারকন্টিনেন্টালে সংবাদ সম্মেলন। বিকালে তার যোগ দেওয়ার কথা জাতীয় দলের ক্যাম্পে। ২৫ মার্চ ভারতের বিপক্ষে শিলংয়ে অভিষেক হবে বর্তমানে শেফিল্ড ইউনাইটেডের এই মিডফিল্ডারের।
হামজা চৌধুরী একাধারে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক, বাংলাদেশেরও নাগরিক। হামজা চৌধুরীর বাবা দেওয়ান মোর্শেদ চৌধুরী জানান, ‘মাতৃভূমির প্রতি অসামান্য টানের কারণে সে আসছে। শিকড় যাতে ভুলে না যায়, সে কারণেই তাকে আমি এখানে নিয়ে এসেছি। জোর করিনি, সে নিজের ইচ্ছায় এসেছে।’
ছোটবেলা থেকে চঞ্চল দেওয়ান হামজা চৌধুরী। খেলাধুলার প্রতি তার ছিল প্রচণ্ড ঝোঁক। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ফুটবল খেলা শুরু। খেলতেন পাড়ার ক্লাবে। ২০০৫ সালে সাত বছর বয়সে মা-বাবা তাকে ভর্তি করিয়ে দেন ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী লেস্টার সিটি ক্লাবে। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি খেলাধুলায় ডিগ্রি নেন। ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-২১ দলে খেলেছেন হামজা। ২৭ বছর বয়সি এই ফুটবলার লেস্টার সিটির হয়ে এ পর্যন্ত ৯১ ম্যাচ খেলেছেন। লেস্টারের হয়ে জিতেছেন এফএ কাপ ও এফএ কমিউনিটি শিল্ড। এ মৌসুমে তিনি লেস্টার থেকে ধারে খেলছেন ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় স্তরের লিগের ক্লাব শেফিল্ড ইউনাইটেডে।
হামজার বাবা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ বলেন, ‘একবার হামজা দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল। কিন্তু তাকে দেওয়া হয় দ্বিতীয় পুরস্কার। সে পুরস্কার নেয়নি। কারণ, সে প্রথম হয়েছিল। জীবনে কোনো খেলায় সে দ্বিতীয় হয়নি। প্রথম হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সাত বছর বয়স থেকে সে লেস্টার ক্লাবের সদস্য। তার খেলা দেখে সেই ছোটবেলা থেকে বহু ক্লাব থেকে তাকে নেওয়ার জন্য অফার দিয়েছে। আমরা রাজি হয়নি। এখনো সে লেস্টারেই আছে। এখানেই তার ফুটবলের আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি।’
দেওয়ান হামজা চৌধুরী জেলার বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার দেওয়ানবাড়ির সন্তান। জেলাজুড়ে এ বাড়ির খ্যাতি। এখানে জম্মেছেন পির-মাশায়েখ, অনেক গুণিজন। শিক্ষাবিদ, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-সবাই আছেন এ বাড়িতে। এবার যুক্ত হয়েছেন সাড়াজাগানো ফুটবলার। হামজার জন্ম ইংল্যান্ডের লাফবরো শহরে। বাবা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ। মা রাফিয়া চৌধুরী। দুই বছর বয়সে ২০০০ সালে দেশে আসেন। এরপরও এসেছেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু এবারের আসা ভিন্ন। এবার তিনি এসেছেন নিজ দেশের হয়ে খেলতে। সঙ্গে এসেছেন স্ত্রী ও সন্তানরা। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এটি তার প্রথম বাংলাদেশ সফর।
হামজা চৌধুরীর চাচা দেওয়ান মাসুদ বলে, ‘২০১৪ সালে সর্বশেষ দেশে এসেছিল হামজা। ২০২২ সালে সে বিয়ে করেছে। এরপর তার দেশে আসা এই প্রথম। আমরা আনন্দে উদ্বেলিত। ভাতিজার সঙ্গে এবার ভাতিজার বউ এবং নাতি-নাতনিদেরও আমরা দেখছি। তাদের বরণ করে নিতে বাড়ি সাজানো হয়েছে। আমাদের মধ্যে অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করছে। জেলাজুড়ে মানুষের মাঝে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।’
হামজার বাবা বলেন, ‘অনেকেই সংবর্ধনার আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। আমি বারণ করেছি। একে তো রমজান মাস। আবার সে দীর্ঘ জার্নি করে আসছে। ক্লান্ত। এবার আমি বাড়িতে ছোট্ট একটি মঞ্চ করেছি। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন আসছেন। সবার সম্মানে এ আয়োজন। ছোট্ট একটি মঞ্চ তৈরি করেছি। এখানে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে সবাইকে নিয়ে ইফতার। ব্যস এটুকুই। মঙ্গলবার ঢাকায় চলে যাবে।’
হামজার শৈশবের খেলার সঙ্গী আবদুল আজিজ বলেন, ‘ছোটবেলায় হামজা আমাদের সঙ্গে খেলেছেন। তখনই আমরা বুঝেছি, হামজা একদিন অনেক বড় খেলোয়াড় হবেন।’ আরেক মাদ্রাসাছাত্র আবদুল মোমিন বলেন, ‘হামজার জন্য আমরা প্রাণভরে দোয়া করি। তিনি যেন আমাদের দেশকে নিয়ে একদিন বিশ্বকাপ আসরে খেলতে পারেন। আমরা বিশ্বাস করি, তিনি আমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন, ইনশাআল্লাহ।