১৬ বছরে লেনদেন সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা
চেয়ারম্যানের কাঁধে চড়ে এমপির টাকা পাচার
এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর ক্যাশিয়ার চেয়ারম্যান লাক মিয়া ‘আঙুল ফুলে বটগাছ’

যুগান্তর প্রতিবেদন, নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছেন ‘দুর্নীতির বরপুত্র’খ্যাত আড়াইহাজার উপজেলার ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লাক মিয়া। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গত ১৬ বছরে লেনদেন হয়েছে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। সামান্য একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের অ্যাকাউন্টে এই অস্বাভাবিক লেনদেন দেখে অনুসন্ধানে নামা দুদক কর্মকর্তাদের চোখ কপালে উঠেছে। নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক প্রভাবশালী সংসদ-সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর ক্যাশিয়ার হিসাবে পরিচিত লাক মিয়া ছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী। স্থানীয়দের অভিযোগ, এমপি নজরুল ইসলাম বাবু তার অবৈধ পথে উপার্জিত হাজার কোটি টাকা লাক মিয়ার ব্যবসায়িক ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেশের বাইরে পাচার করেছেন। আর বাবুর প্রভাব খাটিয়ে নিজে শুধু আঙুল ফুলে কলাগাছ নয় ‘বটগাছে’ পরিণত হয়েছেন লেখাপড়া না জানা লাক মিয়া।
স্থানীয়দের অভিযোগ, তিনবারের সংসদ-সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। তার টাকা পাচারের অন্যতম সহযোগী ছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা লাক মিয়া। বিগত সময়ে এমপি বাবু উপজেলায় বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। এর মধ্যে বিষনান্দি ইউনিয়নে মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষে ফলিত রসায়ন পুষ্টিবিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউট, আড়াইহাজার পুরাতন বিমানবন্দরে কৃষি ইনস্টিটিউট ও ট্রেনিং সেন্টার, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ঘেঁষে সাত গ্রাম ইউনিয়নের পাঁচরুখী এলাকায় জাপান ইপিজেড। এসব প্রকল্পের জমি কেনা থেকে শুরু করে মাটি ভরাটসহ সব কার্যক্রমই এমপি বাবু তার ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার দিয়ে করিয়ে মোটা অঙ্কের কমিশন হাতিয়ে নেন। এছাড়া টেন্ডারবাজি ও কমিশন বাণিজ্য করে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আর এসব টাকা লাক মিয়ার মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন।
দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, লাক মিয়ার ৪৯টি ব্যাংক হিসাবে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য। লাক মিয়া চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালনকালে ৭ হাজার ১৮৮ কোটি ৮৬ লাখ ৫ হাজার ২০৮ টাকা জমা দেন এবং ৭ হাজার ১৮৭ কোটি ৩২ লাখ ৪৭ হাজার ২৯৩ টাকা উত্তোলন করেন। অর্থাৎ তিনি তার ব্যাংক হিসাবে ১৪ হাজার ৩৭৬ কোটি ১৮ লাখ ৫২ হাজার ৫০১ টাকা লেনদেন করেছেন। লাক মিয়া তার ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক লেনদেনের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তর করে মানি লন্ডারিং করেছেন। যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আসামি লাক মিয়ার জ্ঞাতআয়ের সঙ্গে লেনদেনগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন জানান, লাক মিয়া ঘুস ও দুর্নীতি, ভিজিডি, ভিজিএফ, এলজিএসপি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জোরর্পূবক জমি দখল ও মাদক ব্যবসা করে অর্জিত অর্থ ব্যাংক হিসাবে লেনদেন করেছেন। তিনি বলেন, দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, আসামি লাক মিয়া ৪১ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ ও ১৬ কোটি ৭৩ লাখ ৬৭ হাজার ১৪০ টাকার অস্থাবর সম্পদসহ মোট ৫৮ কোটি ৬৯ লাখ ৭৯ হাজার ১৪০ টাকা মূল্যের সম্পদ অর্জন করেছেন। কিন্তু এর বিপরীতে বৈধ আয়ের উৎস পাওয়া যায় মাত্র ৩ কোটি ৪৬ লাখ ২৬ হাজার ১৮৯ টাকার। বাকি ৫৫ কোটি ২৩ লাখ ৫২ হাজার ৯৫১ টাকার বৈধ আয়ের উৎস পাওয়া যায়নি। দাখিলকৃত আয়কর রিটার্নে লাক মিয়া মৎস্য ও বাড়ি ভাড়া খাতে ১২ কোটি টাকার বেশি আয় দেখালেও অনুসন্ধান চলাকালীন দালিলিক কোনো কাগজপত্র উপস্থাপন করতে পারেননি। লাক মিয়ার দখলে রাখা ৫৫ কোটি ২৩ লাখ ৫২ হাজার ৯৫১ টাকা মূল্যের সম্পত্তি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ কারণে আসামি লাক মিয়ার বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে।
দুদক মহাপরিচালক আক্তার হোসেন আরও জানান, অনুসন্ধানে সংগৃহীত রেকর্ডপত্র ও তথ্যাদি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, লাক মিয়ার স্ত্রী মাহমুদা বেগমের ৭ কোটি ৪৭ লাখ ৯৩ হাজার ৪২৪ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ ও ৮ কোটি ৩৯ লাখ ১৩ হাজার ৭৯১ টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদসহ মোট ১৫ কোটি ৮৭ লাখ ৭ হাজার ২১৫ টাকা অর্জন করেছেন। এই সম্পদের বিপরীতে তার আয়ের বৈধ উৎস পাওয়া যায় মাত্র ১ কোটি ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার ১৮ টাকা। অর্থাৎ বাকি ১৪ কোটি ৫০ লাখ ২৩ হাজার টাকার বৈধ আয়ের উৎস পাওয়া যায়নি। বিগত ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিবারিক ব্যয় পাওয়া যায় ২ কোটি ৬৭ লাখ ২৭ হাজার টাকা। কিন্তু তার পরিবারিক ব্যয়সহ মোট অর্জিত সম্পত্তির পরিমাণ ১৫ কোটি ৩৫ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। তিনি ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দাখিলকৃত রিটার্নে মৎস্য খাত থেকে আয় বাবদ ১১ কোটি ৩১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা দেখিয়েছেন। কিন্তু মৎস্য খাতে আয়ের পক্ষে দাললিক কোনো প্রমাণপত্র উপস্থাপন করতে পারেননি। ফলে মাহমুদা বেগমের আয়ের উৎসের সঙ্গে সম্পদ অর্জন সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তিনি জ্ঞাত আয়ের বাইরে ১৪ কোটি ৫০ লাখ ২৩ হাজার টাকা অসদুপায়ে অর্জন করে নিজের দখলে রেখেছেন। যা দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ কারণে দুদক তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
২০১৩ সালে এমপি নজরুল ইসলাম বাবুকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে ভোটকেন্দ্র দখল করে প্রথমবার বাহ্মন্দী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর এমপি বাবুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন লাক মিয়া। এমপি বাবুর প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে পুরো ইউনিয়নবাসীকে জিম্মি করে লাক মিয়া গঠন করেন বিশাল ক্যাডার বাহিনী। এই বাহিনীর সহায়তায় তার স্পিনিং মিলের পরিধি বাড়াতে নিরীহ মানুষের বাড়িঘর, জমি দখল করে নেন। তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও করার সাহস পাননি কেউ। কেউ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলে ধরে এনে বিচারের নামে করা হতো নির্যাতন। মামলা দিয়ে করা হতো হয়রানি। গত ১৬ বছরে স্পিনিং মিলের বেশ কয়েকটি ইউনিট বাড়ান লাক মিয়া। উজানগোপিন্দি মনোহরদী এলাকায় গড়ে তুলেন বিলাসবহুল চোখ ধাঁধানো বাংলোবাড়ি। এই বাড়িতে রয়েছে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, জলসাঘর ও সুইমিংপুল। বাড়ি নির্মাণ করার জন্য বিদেশ থেকে আনা হয়েছে টাইলসসহ যাবতীয় ফিটিংস। বিশাল বাউন্ডারি দিয়ে অনেক নিরীহ মানুষের জমি দখল করে নিয়েছেন। বছরের পর বছর তার পেছনে ঘুরেও জমি উদ্ধার বা বিনিময়ে টাকা পাননি। এমনই একজন ভুক্তভোগী মনোহরদী গ্রামের সুইজারল্যান্ড প্রবাসী জসিম উদ্দিন। তার ভাতিজা সোহেল মিয়া বলেন, তার চাচা জসিম উদ্দিনের প্রায় ১৩ শতাংশ জমি জোরপূর্বক দখল করে মাটি ফেলে ভরাট করে ফেলেছে। বর্তমানে বাড়ির বাউন্ডারির ভেতরে এই জমি রয়েছে। জমির জন্য কোনো টাকা-পয়সাও দেয়নি। তিনি বলেন, আমাদের প্রায় দুই বিঘা জমি দখল করে নেওয়ার চেষ্টা করে লাক মিয়া ও তার বাহিনীর ক্যাডাররা। জমি তার কাছে বিক্রি না করায় নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিয়ে ভয়ভীতি দেখায়। কিন্তু দখল করতে পারেনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হত্যা মামলায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লাক মিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২ দিনের রিমান্ডে নেন হত্যা মামলার তদন্তাকারী কর্মকর্তা। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে উপস্থাপন করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বর্তমানে লাক মিয়া কারাগারে বন্দি রয়েছেন।